বনস্পতি, তুমি যে ভীষণ ক্ষণে ক্ষণে আজিও তা মানে মোর মন। প্রকাণ্ড মাহাত্ম্যবলে জেনেছিলে ধরা একদিন যে আদি অরণ্যযুগে, আজি তাহা ক্ষীণ। মানুষের-বশ-মানা এই-যে তোমায় আজ দেখি, তোমার আপন রূপ এ কি? আমার বিধান দিয়ে বেঁধেছি তোমারে আমার বাসার চারি ধারে। ছায়া তব রেখেছি সংযমে। দাঁড়ায়ে রয়েছ স্তব্ধ জনতাসংগমে হাটের পথের ধারে। নম্র পত্রভারে কিংকরের মতো আছ মোর বিলাসের অনুগত। লীলাকাননের মাপে তোমারে করেছি খর্ব। মৃদু কলালাপে কর চিত্তবিনোদন, এ ভাষা কি তোমার আপন? একদিন এসেছিলে আদিবনভূমে; জীবলোক মগ্ন ঘুমে-- তখনো মেলে নি চোখ, দেখে নি আলোক। সমুদ্রের তীরে তীরে শাখায় মিলায়ে শাখা ধরার কঙ্কাল দিলে ঢাকা। ছায়ায় বুনিয়া ছায়া স্তরে স্তরে সবুজ মেঘের মতো ব্যাপ্ত হলে দিকে দিগন্তরে। লতায় গুল্মেতে ঘন, মৃতগাছ-শুষ্কপাতা-ভরা, আলোহীন পথহীন ধরা। অরণ্যের আর্দ্র গন্ধে নিবিড় বাতাস যেন রুদ্ধশ্বাস চলিতে না পারে। সিন্ধুর তরঙ্গধ্বনি অন্ধকারে গুমরিয়া উঠিতেছে জনশূন্য বিশ্বের বিলাপে। ভূমিকম্পে বনস্থলী কাঁপে; প্রচণ্ড নির্ঘোষে বহু তরুভার বহি বহুদূর মাটি যায় ধ্বসে গভীর পঙ্কের তলে। সেদিনের অন্ধযুগে পীড়িত সে জলে স্থলে তুমি তুলেছিলে মাথা। বলিতে বল্কলে তব গাঁথা সে ভীষণ যুগের আভাস। যেথা তব আদিবাস সে অরণ্যে একদিন মানুষ পশিল যবে দেখা দিয়েছিলে তুমি ভীতিরূপে তার অনুভবে। হে তুমি অমিত-আয়ু, তোমার উদ্দেশে স্তবগান করেছে সে। বাঁকাচোরা শাখা তব কত কী সংকেতে অন্ধকারে শঙ্কা রেখেছিল পেতে। বিকৃত বিরূপ মূর্তি মনে মনে দেখেছিল তারা তোমার দুর্গমে দিশাহারা। আদিম সে আরণ্যক ভয় রক্তে নিয়ে এসেছিনু আজিও সে কথা মনে হয়। বটের জটিল মূল আঁকাবাঁকা নেমে গেছে জলে-- মসীকৃষ্ণ ছায়াতলে দৃষ্টি মোর চলে যেত ভয়ের কৌতুকে, দুরু দুরু বুকে ফিরাতেম নয়ন তখনই। যে মূর্তি দেখেছি সেথা, শুনেছি যে ধ্বনি সে তো নহে আজিকার। বহু লক্ষ বর্ষ আগে সৃষ্টি সে তোমার। হে ভীষণ বনস্পতি, সেদিন যে নতি মন্ত্র পড়ি দিয়েছি তোমারে, আমার চৈতন্যতলে আজিও তা আছে এক ধারে।