এই লেখনগুলি সুরু হয়েছিল চীনে জাপানে। পাখায় কাগজে রুমালে কিছু লিখে দেবার জন্যে লোকের অনুরোধে এর উৎপত্তি। তারপরে স্বদেশে ও অন্য দেশেও তাগিদ পেয়েছি। এমনি ক'রে এই টুকরো লেখাগুলি জমে উঠ্ল। এর প্রধান মূল্য হাতের অক্ষরে ব্যক্তিগত পরিচয়ের । সে পরিচয় কেবল অক্ষরে কেন, দ্রুতলিখিত ভাবের মধ্যেও ধরা পড়ে। ছাপার অক্ষরে সেই ব্যক্তিগত সংস্রবটি নষ্ট হয়-- সে অবস্থায় এই সব লেখা বাতি-নেবা চীন লণ্ঠনের মতো হাল্কা ও ব্যর্থ হতে পারে। তাই জর্ম্মনিতে হাতের অক্ষর ছাপবার উপায় আছে খবর পেয়ে লেখনগুলি ছাপিয়ে নেওয়া গেল। অন্যমনস্কতায় কাটাকুটি ভুলচুক ঘটেছে। সে সব ত্রুটিতেও ব্যক্তিগত পরিচয়েরই আভাস রয়ে গেল॥ শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম গ্রামের পথে পথে, তুমি তখন চলেছিলে তোমার স্বর্ণরথে। অপূর্ব এক স্বপ্ন-সম লাগতেছিল চক্ষে মম-- কী বিচিত্র শোভা তোমার, কী বিচিত্র সাজ। আমি মনে ভাবেতেছিলেম, এ কোন্ মহারাজ। আজি শুভক্ষণে রাত পোহালো ভেবেছিলেম তবে, আজ আমারে দ্বারে দ্বারে ফিরতে নাহি হবে। বাহির হতে নাহি হতে কাহার দেখা পেলেম পথে, চলিতে রথ ধনধান্য ছড়াবে দুই ধারে-- মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব, নেব ভারে ভারে। দেখি সহসা রথ থেমে গেল আমার কাছে এসে, আমার মুখপানে চেয়ে নামলে তুমি হেসে। দেখে মুখের প্রসন্নতা জুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা, হেনকালে কিসের লাগি তুমি অকস্মাৎ "আমায় কিছু দাও গো' বলে বাড়িয়ে দিলে হাত। মরি, এ কী কথা রাজাধিরাজ, "আমায় দাও গো কিছু'! শুনে ক্ষণকালের তরে রইনু মাথা-নিচু। তোমার কী-বা অভাব আছে ভিখারী ভিক্ষুকের কাছে। এ কেবল কৌতুকের বশে আমায় প্রবঞ্চনা। ঝুলি হতে দিলেম তুলে একটি ছোটো কণা। যবে পাত্রখানি ঘরে এনে উজাড় করি-- এ কী! ভিক্ষামাঝে একটি ছোটো সোনার কণা দেখি। দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে, তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভরে-- তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে।
ওগো, তোরা বল্ তো এরে ঘরে বলি কোন্ মতে। এরে কে বেঁধেছে হাটের মাঝে আনাগোনার পথে। আসতে যেতে বাঁধে তরী আমারি এই ঘাটে, যে খুশি সেই আসে--আমার এই ভাবে দিন কাটে। ফিরিয়ে দিতে পারি না যে হায় রে-- কী কাজ নিয়ে আছি, আমার বেলা বহে যায় যে, আমার বেলা বহে যায় রে। পায়ের শব্দ বাজে তাদের, রজনীদিন বাজে। ওগো, মিথ্যে তাদের ডেকে বলি, "তোদের চিনি না যে!' কাউকে চেনে পরশ আমার, কাউকে চেনে ঘ্রাণ, কাউকে চেনে বুকের রক্ত, কাউকে চেনে প্রাণ। ফিরিয়ে দিতে পারি না যে হায় রে-- ডেকে বলি, "আমার ঘরে যার খুশি সেই আয় রে, তোরা যার খুশি সেই আয় রে।' সকালবেলায় শঙ্খ বাজে পুবের দেবালয়ে-- ওগো, স্নানের পরে আসে তারা ফুলের সাজি লয়ে। মুখে তাদের আলো পড়ে তরুণ আলোখানি; অরুণ পায়ের ধুলোটুকু বাতাস লহে টানি। ফিরিয়ে দিতে পারি না যে হায় রে-- ডেকে বলি, "আমার বনে তুলিবি ফুল আয় রে তোরা, তুলিবি ফুল আয় রে।' দুপুরবেলা ঘণ্টা বাজে রাজার সিংহদ্বারে। ওগো, কী কাজ ফেলে আসে তারা এই বেড়াটির ধারে। মলিনবরন মালাখানি শিথিল কেশে সাজে, ক্লিষ্টকরুণ রাগে তাদের ক্লান্ত বাঁশি বাজে। ফিরিয়ে দিতে পারি না যে হায় রে-- ডেকে বলি, "এই ছায়াতে কাটাবি দিন আয় রে তোরা, কাটাবি দিন আয় রে।' রাতের বেলা ঝিল্লি ডাকে গহন বনমাঝে। ওগো, ধীরে ধীরে দুয়ারে মোর কার সে আঘাত বাজে। যায় না চেনা মুখখানি তার, কয় না কোনো কথা, ঢাকে তারে আকাশ-ভরা উদাস নীরবতা। ফিরিয়ে দিতে পারি না যে হায় রে-- চেয়ে থাকি সে মুখ-পানে-- রাত্রি বহে যায়, নীরবে রাত্রি বহে যায় রে।