গোধূলিতে নামল আঁধার, ফুরিয়ে গেল বেলা, ঘরের মাঝে সাঙ্গ হল চেনা মুখের মেলা। দূরে তাকায় লক্ষ্যহারা নয়ন ছলোছলো, এবার তবে ঘরের প্রদীপ বাইরে নিয়ে চলো। মিলনরাতে সাক্ষী ছিল যারা আজো জ্বলে আকাশে সেই তারা। পাণ্ডু-আঁধার বিদায়রাতের শেষে যে তাকাত শিশিরসজল শূন্যতা-উদ্দেশে সেই তারকাই তেমনি চেয়েই আছে অস্তলোকের প্রান্তদ্বারের কাছে। অকারণে তাই এ প্রদীপ জ্বালাই আকাশ-পানে-- যেখান হতে স্বপ্ন নামে প্রাণে।
আজ হল রবিবার, খুব মোটা বহরের কগজের এডিশন; যত আছে শহরের কানাকানি, যত আছে আজগবি সংবাদ, যায় নিকো কোনোটার একটুও রঙ বাদ। "বার্তাকু' লিখে দিল, গুজরানওয়ালায় দলে দলে জোট করে পাঞ্জাবি গোয়ালায়। বলে তারা, গোরু পোষা গ্রাম্য এ কারবার প্রগতির যুগ আজ দিন এল ছাড়বার। আজ থেকে প্রত্যহ রাত্তির পোয়ালেই বসবে প্রেপরিটরি ক্লাস এই গোয়ালেই। স্তূপ রচা দুই বেলা খড়-ভুষি-ঘাসটার ছেড়ে দিয়ে হবে ওরা ইস্কুলমাস্টার। হম্বাধ্বনি যাহা গো-শিশু গো-বৃদ্ধের অন্তর্ভূত হবে বই-গেলা বিদ্যের। যত অভ্যেস আছে লেজ ম'লে পিটোনো ছেলেদের পিঠে হবে পেট ভ'রে মিটোনো। "গদাধরে' রেগে লেখে, এ কেমন ঠাট্টা-- বার্তাকু পরে পরে সাতটা কি আটটা যা লিখেছে সব কটা সমাজের বিরোধী, মতগুলো প্রগতির দ্বার আছে নিরোধি। সেদিন সে লিখেছিল, ঘুঁটে চাই চালানো, শহরের ঘরে ঘরে ঘুঁটে হোক জ্বালানো। কয়লা ঘুঁটেতে যেন সাপে আর নেউলে, ঝড়িয়াকে করে দিক একদম দেউলে। সেনেট হাউস আদি বড়ো বড়ো দেয়ালী শহরের বুক জুরে আছে যেন হেঁয়ালি। ঘুঁটে দিয়ে ভরা হোক, এই এক ফতোয়ায় এক দিনে শহরের বেড়ে যাবে কত আয়। গোয়ালারা চোনা যদি জমা করে গামলায় কত টাকা বাঁচে তবে জল-দেওয়া মামলায়। বার্তাকু কাগজের ব্যঙ্গে যে গা জ্বলে, সুন্দর মুখ পেলে লেপে ওরা কাজলে। এ-সকল বিদ্রূপে বুদ্ধি যে খেলো হয়, এ দেশের আবহাওয়া ভারি এলোমেলো হয়। গদাধর কাগজের ধমকানি থামল, হেসে উঠে বার্তাকু যুদ্ধেতে নামল। বলে, ভায়া, এ জগতে ঠাট্টা সে ঠাট্টাই-- গদাধর, গদা রেখে লও সেই পাঠটাই। মাস্টার না হয়ে যে হলে তুমি এডিটর এ লাগি তোমার কাছে দেশটাই ক্রেডিটর। এডুকেশনের পথে হয় নি যে মতি তব, এই পুণ্যেই হবে গোকুলেই গতি তব। অবশেষে এ দুখানা কাগজের আসরে বচসার ঝাঁজ দেখে ভয়ে কথা না সরে।
যে পলায়নের অসীম তরণী বাহিছে সূর্যতারা সেই পলায়নে দিবসরজনী ছুটেছ গঙ্গাধারা। চিরধাবমান নিখিলবিশ্ব এ পলায়নের বিপুল দৃশ্য, এই পলায়নে ভূত ভবিষ্য দীক্ষিছে ধরণীরে। জলের ছায়া সে দ্রুততালে বয়, কঠিন ছায়া সে ওই লোকালয়, একই প্রলয়ের বিভিন্ন লয় স্থিরে আর অস্থিরে। সৃষ্টি যখন আছিল নবীন নবীনতা নিয়ে এলে, ছেলেমানুষির স্রোতে নিশিদিন চল অকারণ খেলে। লীলাছলে তুমি চিরপথহারা, বন্ধনহীন নৃত্যের ধারা, তোমার কুলেতে সীমা দিয়ে কারা বাঁধন গড়িছে মিছে। আবাঁধা ছন্দে হেসে যাও সরি পাথরের মুঠি শিথিলিত করি, বাঁধাছন্দের নগরনগরী ধুলায় মিলায় পিছে। অচঞ্চলের অমৃত বরিষে চঞ্চলতার নাচে, বিশ্বলীলা তো দেখি কেবলি সে নেই নেই ক'রে আছে। ভিত ফেঁদে যারা তুলিছে দেয়াল তারা বিধাতার মানে না খেয়াল, তারা বুঝিল না-- অনন্তকাল অচির কালেরই মেলা। বিজয়তোরণ গাঁথে তারা যত আপনার ভারে ভেঙে পড়ে তত, খেলা করে কাল বালকের মতো লয়ে তার ভাঙা ঢেলা। ওরে মন, তুই চিন্তার টানে বাঁধিস নে আপনারে, এই বিশ্বের সুদূর ভাসানে অনায়াসে ভেসে যা রে। কী গেছে তোমার কী রয়েছে আর নাই ঠাঁই তার হিসাব রাখার, কী ঘটিতে পারে জবাব তাহার নাই বা মিলিল কোনো। ফেলিতে ফেলিতে যাহা ঠেকে হাতে তাই পরশিয়া চলো দিনে রাতে, যে সুর বাজিল মিলাতে মিলাতে তাই কান দিয়ে শোনো। এর বেশি যদি আরো কিছু চাও দুঃখই তাহে মেলে। যেটুকু পেয়েছে তাই যদি পাও তাই নাও, দাও ফেলে। যুগ যুগ ধরি জেনো মহাকাল চলার নেশায় হয়েছে মাতাল, ডুবিছে ভাসিছে আকাশ পাতাল আলোক আঁধার বহি। দাঁড়াবে না কিছু তব আহ্বানে, ফিরিয়া কিছু না চাবে তোমা-পানে, ভেসে যদি যাও যাবে একখানে সকলের সাথে রহি।