রাজা করে রণযাত্রা, বাজে ভেরি, বাজে করতাল-- কম্পমান বসুন্ধরা। মন্ত্রী ফেলি ষড়যন্ত্রজাল রাজ্যে রাজ্যে বাধায় জটিল গ্রন্থি। বাণিজ্যের স্রোত ধরণী বেষ্টন করে জোয়ার-ভাঁটায়। পণ্যপোত ধায় সিন্ধুপারে-পারে। বীরকীর্তিস্তম্ভ হয় গাঁথা লক্ষ লক্ষ মানবকঙ্কালস্তূপে, ঊর্ধ্বে তুলি মাথা চূড়া তার স্বর্গ-পানে হানে অট্টহাস। পণ্ডিতেরা-- আক্রমণ করে বারম্বার পুঁথির-প্রাচীর-ঘেরা দুর্ভেদ্য বিদ্যার দুর্গ। খ্যাতি তার ধায় দেশে দেশে। হেথা গ্রামপ্রান্তে নদী বহি চলে প্রান্তরের শেষে ক্লান্ত স্রোতে। তরীখানি তুলি লয়ে নববধূটিরে চলে দূর পল্লী-পানে। সূর্য অস্ত যায়। তীরে তীরে স্তব্ধ মাঠ। দুরুদুরু বালিকার হিয়া। অন্ধকারে ধীরে ধীরে সন্ধ্যাতারা দেখা দেয় দিগন্তের ধারে।
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো-- গভীর শান্তি এ যে, আমার সকল ছাড়িয়ে গিয়ে উঠল কোথায় বেজে। ছাড়িয়ে গৃহ, ছাড়িয়ে আরাম, ছাড়িয়ে আপনারে সাথে করে নিল আমায় জন্মমরণপারে-- এল পথিক সেজে। দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো-- গভীর শান্তি এ যে। চরণে তার নিখিল ভুবন নীরব গগনেতে আলো-আঁধার আঁচলখানি আসন দিল পেতে। এত কালের ভয় ভাবনা কোথায় যে যায় সরে, ভালোমন্দ ভাঙাচোরা আলোয় ওঠে ভরে, কালিমা যায় মেজে। দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো-- গভীর শান্তি এ যে।
হে প্রিয়, আজি এ প্রাতে নিজ হাতে কী তোমারে দিব দান। প্রভাতের গান? প্রভাত যে ক্লান্ত হয় তপ্ত রবিকরে আপনার বৃন্তটির 'পরে; অবসন্ন গান হয় অবসান। হে বন্ধু কী চাও তুমি দিবসের শেষে মোর দ্বারে এসে। কী তোমারে দিব আনি। সন্ধ্যাদীপখানি? এ-দীপের আলো এ যে নিরালা কোণের, স্তব্ধ ভবনের। তোমার চলার পথে এরে নিতে চাও জনতায়? এ যে হায় পথের বাতাসে নিবে যায়। কী মোর শকতি আছে তোমারে যে দিব উপহার। হোক ফুল, হোক-না গলার হার, তার ভার কেনই বা সবে, একদিন যবে নিশ্চিত শুকাবে তারা ম্লান ছিন্ন হবে। নিজ হতে তব হাতে যাহা দিব তুলি তারে তব শিথিল অঙ্গুলি যাবে ভুলি-- ধূলিতে খসিয়া শেষে হয়ে যাবে ধূলি। তার চেয়ে যবে ক্ষণকাল অবকাশ হবে, বসন্তে আমার পুষ্পবনে চলিতে চলিতে অন্যমনে অজানা গোপন গন্ধে পুলকে চমকি দাঁড়াবে থমকি, পথহারা সেই উপহার হবে সে তোমার। যেতে যেতে বীথিকায় মোর চোখেতে লাগিবে ঘোর, দেখিবে সহসা-- সন্ধ্যার কবরী হতে খসা একটি রঙিন আলো কাঁপি থরথরে ছোঁয়ায় পরশমণি স্বপনের 'পরে, সেই আলো, অজানা সে উপহার সেই তো তোমার। আমার যা শ্রেষ্ঠধন সে তো শুধু চমকে ঝলকে, দেখা দেয়, মিলায় পলকে। বলে না আপন নাম, পথেরে শিহরি দিয়া সুরে চলে যায় চকিতে নূপুরে। সেথা পথ নাহি জানি, সেথা নাহি যায় হাত, নাহি যায় বাণী। বন্ধু, তুমি সেথা হতে আপনি যা পাবে আপনার ভাবে, না-চাহিতে না-জানিতে সেই উপহার সেই তো তোমার। আমি যাহা দিতে পারি সামান্য সে দান-- হোক ফুল, হোক তাহা গান।