তোমায় সৃষ্টি করব আমি এই ছিল মোর পণ। দিনে দিনে করেছিলেম তারি আয়োজন। তাই সাজালেম আমার ধুলো, আমার ক্ষুধাতৃষ্ণাগুলো, আমার যত রঙিন আবেশ, আমার দুঃস্বপন। "তুমি আমায় সৃষ্টি করো' আজ তোমারে ডাকি-- "ভাঙো আমার আপন মনের মায়া-ছায়ার ফাঁকি। তোমার সত্য, তোমার শান্তি, তোমার শুভ্র অরূপ কান্তি, তোমার শক্তি, তোমার বহ্নি ভরুক এ জীবন।'
একদা বিজনে যুগল তরুর মূলে তৃষ্ণার জল তুমি দিয়েছিলে তুলে। আর কোনোখানে ছায়া নাহি দেখি, শুধালেম, কাছে বসিতে দিবে কি। সেদিন তোমার ঘরে ফিরিবার বেলা বহে গেল বুঝি, কাজে হয়ে গেল হেলা। অদূরে হোথায় ভাঙা দেউলের ধারে পূর্ব যুগের পূজাহীন দেবতারে প্রভাত-অরুণ প্রতিদিন খোঁজে, শূন্য বেদির অর্থ না বোঝে, দিন শেষ হলে সন্ধ্যাতারার আলো যে পূজারী নাই তারে বলে, দীপ জ্বালো। একদিন বুঝি দূরে কোন্ রাজধানী রচনা করেছে দীর্ঘ এ পথখানি। আজি তার নাম নাই ইতিহাসে; জীর্ণ হয়েছে বালুকার গ্রাসে, প্রান্তরশেষে শীর্ণ বনের কোলে জনপদবধূ জল নিয়ে যায় চলে। লুপ্তকালের শুষ্ক সাগরধারে বহু বিস্মৃতি যেথা রয় স্তূপাকারে, অতি পুরাতন কাহিনী যেথায় রুদ্ধ কণ্ঠে শূন্যে তাকায়, হারানো ভাষার নিশার স্বপ্নছায়ে হেরিনু তোমায়, আসিনু ক্লান্ত পায়ে। শুধু দুটি তরু মরুর প্রাণের কথা, লুকানো কী রসে বাঁচে তার শ্যামলতা। সেদিন তাহারি মর্মর-সনে কী ব্যথা মিশানু, জানে দুইজনে; মাথার উপরে উড়ে গেল কোন্ পাখি হতাশ পাখার হাহাকাররেখা আঁকি। তপ্ত বালুর ভর্ৎসিয়া মুহু মুহু তাপিত বাতাস চিৎকারি উঠে হুহু; ধূলির ঘূর্ণি, যেন বেঁকে বেঁকে শাপ-লাগা প্রেত নাচে থেকে থেকে; রূঢ় রুদ্র রিক্তের মাঝখানে দুইটি প্রহর ভরেছিনু প্রাণে গানে। দিন শেষ হল, চলে যেতে হল একা, বলিনু তোমারে, আরবার হবে দেখা। শুনে হেসেছিলে হাসিখানি ম্লান, তরুণ হৃদয়ে যেন তুমি জান অসীমের বুকে অনাদি বিষাদখানি আছে সারাখন মুখে আবরণ টানি। তার পরে কত দিন চলে গেল মিছে একটি দিনেরে দলিয়া পায়ের নীচে। বহু পরে যবে ফিরিলাম প্রিয়ে, এ পথে আসিতে দেখি চমকিয়ে আছে সেই কূপ, আছে সে যুগলতরু। তুমি নাই, আছে তৃষিত স্মৃতির মরু। এ কূপের তলে মোর যক্ষের ধন একটি দিনের দুর্লভ সেইখন চিরকাল ভরি রহিল লুকানো, ওগো অগোচরা জান নাহি জান; আর কোনো দিনে অন্য যুগের প্রিয়া তারে আর-কারে দিবে কি উদ্ধারিয়া।