রোজই ডাকি তোমার নাম ধরে, বলি "চারু'। হঠাৎ ইচ্ছা হল আর-কিছু বলি, যাকে বলে সম্ভাষণ, যেমন বলত সত্যযুগের ভালোবাসায়। সব চেয়ে সহজ ডাক-- প্রিয়তমে। সেটা আবৃত্তি করেছি মনে মনে, তার উত্তরে মনে-মনেই শুনেছি তোমার উচ্চহাসি। বুঝেছি, মন্দমধুর হাসি এ যুগের নয়; এ যে নয় অবন্তী, নয় উজ্জয়িনী। আটপহুরে নামটাতে দোষ কী হল এই তোমার প্রশ্ন। বলি তবে। কাজ ছিল না বেশি, সকাল সকাল ফিরেছি বাসায়। হাতে বিকেলের খবরের কাগজ, বসেছি বারান্দায়, রেলিঙে পা দুটো তোলা। হঠাৎ চোখে পড়ল পাশের ঘরে তোমার বৈকালিকী সাজের ধারা। বাঁধছিলে চুল আয়নার সামনে বেণী পাকিয়ে পাকিয়ে, কাঁটা বিঁধে বিঁধে। এমন মন দিয়ে দেখি নি তোমাকে অনেক দিন; দেখি নি এমন বাঁকা করে মাথা-হেলানো চুল-বাঁধার কারিগরিতে, এমন দুই হাতের মিতালি চুড়িবালার ঠুনঠুনির তালে। শেষে ওই ধানিরঙের আঁচলখানিতে কোথাও কিছু ঢিল দিলে, আঁট করলে কোথাও বা, কোথাও একটু টেনে দিলে নীচের দিকে, কবিরা যেমন ছন্দ বদল করে একটু আধটু বাঁকিয়ে চুরিয়ে। আজ প্রথম আমার মনে হল অল্প মজুরির দিন-চালানো একটা মানুষের জন্যে নিজেকে তো সাজিয়ে তুলছে আমাদের ঘরের পুরোনো বউ দিনে দিনে নতুন-দাম দেওয়া রূপে। এ তো নয় আমার আটপহুরে চারু। ঠিক এমনি করেই দেখা দিত অন্যযুগের অবন্তিকা ভালোলাগার অপরূপবেশে ভালোবাসার চকিত চোখে। অমরুশতকের চৌপদীতে --শিখরিণীতে হোক, স্রগ্ধরায় হোক-- ওকে তো ঠিক মানাতো। সাজের ঘর থেকে বসবার ঘরে ওই যে আসছে অভিসারিকা, ও যেন কাছের কালে আসছে দূরের কালের বাণী। বাগানে গেলেম নেমে। ঠিক করেছি আমিও আমার সোহাগকে দেব মর্যাদা শিল্পে-সাজিয়ে-তোলা মানপত্রে। যখন ডাকব তোমাকে ঘরে সে হবে যেন আবাহনী। সামনেই লতা ভরেছে সাদা ফুলে-- বিলিতি নাম, মনে থাকে না-- নাম দিয়েছি তারাঝরা; রাতের বেলায় গন্ধ তার ফুলবাগানের প্রলাপের মতো। এবার সে ফুটেছে অকালে, সবুর সয় নি শীত ফুরোবার। এনেছি তার একটি গুচ্ছ, তারও একটি সই থাকবে আমার নিবেদনে। আজ গোধূলিলগ্নে তুমি ক্লাসিক যুগের চারুপ্রভা, আমি ক্লাসিকযুগের অজিতকুমার। দুটি কথা আজ বলব আমি, সাজানো কথা-- হাসতে হয় হেসো। সে কথা মনে মনে গড়ে তুলেছি যেমন করে তুমি জড়িয়ে তুলেছ তোমার খোঁপা। বলব, "প্রিয়ে, এই পরদেশী ফুলের মঞ্জরী আকাশে চেয়ে খুঁজছিল বসন্তের রাত্রি, এনেছি আমি তাকে দয়া করে তোমার ওই কালো চুলে।"
আমি যে বেশ সুখে আছি অন্তত নই দুঃখে কৃশ, সে কথাটা পদ্যে লিখতে লাগে একটু বিসদৃশ। সেই কারণে গভীর ভাবে খুঁজে খুঁজে গভীর চিতে বেরিয়ে পড়ে গভীর ব্যথা স্মৃতি কিম্বা বিস্মৃতিতে। কিন্তু সেটা এত সুদূর এতই সেটা অধিক গভীর আছে কি না আছে তাহার প্রমাণ দিতে হয় না কবির। মুখের হাসি থাকে মুখে, দেহের পুষ্টি পোষে দেহ, প্রাণের ব্যথা কোথায় থাকে জানে না সেই খবর কেহ। কাব্য প'ড়ে যেমন ভাব কবি তেমন নয় গো। আঁধার ক'রে রাখে নি মুখ, দিবারাত্র ভাঙছে না বুক, গভীর দুঃখ ইত্যাদি সব হাস্যমুখেই বয় গো। ভালোবাসে ভদ্রসভায় ভদ্র পোশাক পরতে অঙ্গে, ভালোবাসে ফুল্ল মুখে কইতে কথা লোকের সঙ্গে। বন্ধু যখন ঠাট্টা করে মরে না সে অর্থ খুঁজে, ঠিক যে কোথায় হাসতে হবে একেক সময় দিব্যি বুঝে। সামনে যখন অন্ন থাকে থাকে না সে অন্যমনে, সন্গীদলের সাড়া পেলে রয় না বসে ঘরের কোণে। বন্ধুরা কয় "লোকটা রসিক', কয় কি তারা মিথ্যামিথ্যি? শত্রুরা কয় "লোকটা হাল্কা', কিছু কি তার নাইকো ভিত্তি? কাব্য দেখে যেমন ভাব কবি তেমন নয় গো। চাঁদের পানে চক্ষু তুলে রয় না পড়ে নদীর কূলে, গভীর দুঃখ ইত্যাদি সব মনের সুখেই বয় গো। সুখে আছি লিখতে গেলে লোকে বলে,"প্রাণটা ক্ষুদ্র! আশাটা এর নয়কো বিরাট, পিপাসা এর নয়কো রুদ্র।' পাঠকদলে তুচ্ছ করে, অনেক কথা বলে কঠোর-- বলে,"একটু হেসে-খেলেই ভরে যায় এর মনের জঠর।' কবিরে তাই ছন্দে বন্ধে বানাতে হয় দুখের দলিল। মিথ্যা যদি হয় সে তবু ফেলো পাঠক চোখের সলিল। তাহার পরে আশিস কোরো রুদ্ধকণ্ঠে ক্ষুব্ধবুকে, কবি যেন আজন্মকাল দুখের কাব্য লেখেন সুখে। কাব্য যেমন কবি যেন তেমন নাহি হয় গো। বুদ্ধি যেন একটু থাকে, স্নানাহারের নিয়ম রাখে, সহজ লোকের মতোই যেন সরল গদ্য কয় গো।