আমি দেখিতেছি মহিলারা রাগ করিতেছেন, অতএব স্ত্রৈণ কাহাকে বলে তাহার একটা মীমাংসা করা আবশ্যক বিবেচনা করিতেছি| এই কথাটা সকলেই ব্যবহার করেন, কিন্তু ইহার অর্থ অতি অল্প লোকেই সর্ব্বতোভাবে বুঝেন। যে ব্যক্তি স্ত্রীকে কিছু বিশেষরূপ ভালবাসে সাধারণতঃ লোকে তাহাকেই স্ত্রৈণ বলে। কিন্তু বাস্তবিক স্ত্রৈণ কে? না, যে ব্যক্তি স্ত্রীকে আশ্রয় দিতে পারে না,স্ত্রীর উপর নির্ভর করে। বলিষ্ঠ পুরুষ হইয়াও অবলা নারীকে ঠেসান দিয়া থাকে! যে ব্যক্তি পড়িয়া গেলে স্ত্রীকে ধরিয়া উঠে, মরিয়া গেলে স্ত্রীকে লইয়া মরে; যে ব্যক্তি সম্পদের সময় স্ত্রীকে পশ্চাতে রাখে ও বিপদের সময় স্ত্রীকে সম্মুখে ধরে; এক কথায় যে ব্যক্তি "আত্মানং সততং রক্ষেৎ দারৈরপি ধনৈরপি" ইহাই সার বুঝিয়াছে, সেই স্ত্রৈণ। অর্থাৎ ইহারা সমস্তই উল্টাপাল্টা করে। ইংরাজ জাতিরা স্ত্রৈণের ঠিক বিপরীত। কারণ, তাহারা স্ত্রীকে হাত ধরিয়া গাড়িতে উঠাইয়া দেয়, স্ত্রীর মুখে আহার তুলিয়া দেয়, স্ত্রীকে ছাতা ধরে ইত্যাদি। তাহারা স্ত্রীলোকদিগকে এতই দুর্ব্বল মনে করে যে, সকল বিষয়েই তাহাদিগকে সাহায্য করে। ইহাদিগকে দেখিয়া স্ত্রৈণ জাতি মুখে কাপড় দিয়া হাসে ও বলে "ইংরাজেরা কি স্ত্রৈণ। কোথায় গর্ম্মি হইলে স্ত্রী সমস্ত রাত জাগিয়া তাহাকে বাতাস দিবে, না, সে স্ত্রীকে বাতাস দেয়! কোথায় যতক্ষণ না বলিষ্ঠ পুরুষদের তৃপ্তিপূর্ব্বক আহার নিঃশেষ হয় ততক্ষণ অবলা জাতিরা উপবাস করিয়া থাকিবে, না, বলীয়ান্ পুরুষ হইয়া অবলার মুখে আহার তুলিয়া দেয়! ছি ছি, কি লজ্জা! এমন যদি হইল তবে আর বল কিসের জন্য!"
সমস্ত জীবনের যে তত্ত্বগুলিকে জানিয়া আসিতেছি,মাঝে মাঝে তাহাদের এক একবার আবিষ্কার করিয়া ফেলি । তাড়াতাড়ি পাশের লোককে ডাকিয়া বলি,ওহে, আমি এই তত্ত্বটি জানিয়াছি । সে বিরক্ত হইয়া বলে, আঃ,ও ত জানা কথা ! কিন্তু ঠিক জানা কথা নয় । তুমি উহা জান বটে , তবু ও জান না। একটা তুলনা দিলে স্পষ্ট হইবে । বাতাস সর্ব্বত্রই বিদ্যমান । তথাপি এক জন যদি বলিয়া উঠে "ওহে এইখানে বাতাস আছে ' তবে তাহাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারি না, তেমনি আমরা যে সকল সাধারণ তত্ত্বের মধ্যে বাস করিয়া থাকি সেই তত্ত্বগুলি অবস্থাবিশেষে এক এক জনের গায়ে লাগে, অমনি সে বলে অমুকতত্ত্বটি পাইতেছি । এক জন বন্ধু বলিতেছিলেন যে,আজকাল সার্ব্বজনীন-উদারতা (humanity) প্রভৃতি কতকগুলি প্রশস্ত কথা উঠিয়াছে, সহসা মনে হয়,কত কি মূল্যবান তত্ত্ব উপার্জন করিতেছি,কিন্তু সে সকল তত্ত্ব বাতাসের মত । বাতাস অত্যন্ত উপকারী পদার্থ বটে, কিন্তু এত সাধারণ যে তাহার কোন মূল্য নাই । তেমনি উপরি-উক্ত তত্ত্বগুলি বড় বড় তত্ত্ব বটে, কিন্তু এত সাধারণ যে তাহার কোন মূল্য নাই ; অথচ আজকাল তাহাদের এমনি বিশেষরূপে উত্থাপিত করা হইতেছে যে, যেন তাহার কতই অসাধারণ ! তাঁহার কথাটা ঠিক মানি না। মহাত্মাদিগের "বসুধৈব কুটুম্বকং" এ কথাটি সকলেই জানেন । অথচ সকলের গায়ে লাগে না । এ তত্ত্বটি মাঝে মাঝে এক এক জনের গায়ে প্রবাহিত হয় অমনি সে বসুধৈব কুটুম্বকং প্রচার করিয়া বেড়ায় । পুরানো-কথা ধরা-কথা পারতপক্ষে কেহ বলিতে চাহে না;অতএব পুরানো কথা যখন কাহারো মুখে শুনা যায়,তখন বিবেচনা করা উচিত -- সে তাহা জানিত বটে কিন্তু আজ নূতন পাইয়াছে, আমাদের ভাগ্যে এখনো তাহা ঘটে নাই । অনেক "উড়ো-কথা"র অপেক্ষা ধরা-কথাকে আমরা কম জানি । আমরা নিজের চোক দেখিতে পাই না, দর্পন পাইলেই দেখিতে পাই;ধরা-কথা ধরিতে পারি না, সিশেষ অভিজ্ঞতা পাইলে ধরি । অতএব যাহারা জানা-কথা জানে,তাহারা সাধারণের চেয়ে অধিক জানে ।