পাঠক-খরিদ্দার লেখক-ব্যাপারীর প্রতি-- "কেন হে, আজকাল তোমার এখানে তেমন ভাল ভাব পাওয়া যায় না কেন?" লেখক-- "মহাশয়, আমার এ ফল ফুলের দোকান। মিঠাই মণ্ডার নহে, যে, নিজের হাতে গড়িয়া দিব। আমার মাথার জমিতে কতকগুলো গাছ আছে। আপনি আমার সঙ্গে বন্দোবস্ত করিয়াছেন, আপনাকে নিয়মিত ফল ফুল যোগাইতে হইবে। কিন্তু ঠিক নিয়ম-অনুসারে ফল ফুল ফলেও না, ফুটেও না; কখন্ ফলে, কখন ফুটে বলিয়া অপেক্ষা করিয়া থাকিতে হয়। কিন্তু তাহা করিলে চলে না, আপনি প্রত্যহ তাগাদা করিতে থাকেন, কই হে , ফুল কই, ফল কই? ফল ধোঁয়া দিয়া বলপূর্ব্বক পাকাইতে হয়, কাজেই আপানারা গাছপাকা ভাবটি পান না। এমন একটা প্রবন্ধ তৈরি হয়, তাহার আঁঠির কাছটা হয়ত টক, খোসার কাছে হয়ত ঈষৎ মিষ্ট; তাহার এক জায়গায় হয়ত থল্থোলে, আর এক জায়গায় হয়ত কাঁচা শক্ত। ফুল ছিঁড়িয়া ফোটাইতে হয়; এমন একটা কবিতা তৈরি হয় যাহার ভালরূপ রঙ্ ধরে নাই, গন্ধ জন্মে নাই, পাপ্ড়িগুলি কোঁক্ড়ানো। রহিয়া বসিয়া কিছু করিতে পারি না, সমস্তই তাড়াতাড়ি করিতে হয়। দেখুন দেখি গাছে কত কুঁড়ি ধরিয়াছে! কি দুঃখ যে, গাছে রাখিয়া ফুটাইতে পারি না! আমাদের দেশীয় কন্যার পিতারা যেমন মেয়েকুঁড়ি গাছে রাখিতে পারেন না, ৮ বৎসরের কুঁড়িটিকে ছিঁড়িয়া বিবাহ দিয়া বলপূর্ব্বক ফুটাইয়া তুলেন ও বেচারীদের বিশ বৎসরের মধ্যে ঝরিয়া পড়িবার লক্ষণ প্রকাশিত হয়। আমার বলপূর্ব্বক-ফোটান' কবিতার কুঁড়িগুলিও দেখিতে দেখিতে ঝরিয়া পড়ে। কিন্তু ইহা অপেক্ষাও আমার আর একটা আপ্শোষ আছে; আমার যে কুঁড়িগুলি ফুটিল না সেগুলি যদি ফুটিত, যে মুকুলগুলি ঝরিয়া গেল তাহাতে যদি ফল ধরিত, তবে কি কীর্ত্তিই লাভ করিতাম!"
এক এক জন লোক আছে, তাহারা যতক্ষণ একলা থাকে ততক্ষণ কিছুই নহে, একটা শূন্য (০) মাত্র, কিন্তু একের সহিত যখনি যুক্ত হয় তখনি দশ (১০) হইয়া পড়ে। একটা আশ্রয় পাইলে তাহারা কি না করিতে পারে! সংসারে শত সহস্র "শূন্য ' আছে, বেচারীদের সকলেই উপেক্ষা করিয়া থাকে-- তাহার একমাত্র কারণ সংসারে আসিয়া তাহারা উপযুক্ত "এক' পাইল না, কাজেই তাহাদের অস্তিত্ব না থাকার মধ্যেই হইল। এই সকল শূন্যদের এক মহা দোষ এই যে, পরে বসিলে ইহারা ১কে ১০ করে বটে, কিন্তু আগে বসিলে দশমিকের নিয়মানুসারে ১কে তাহার শতাংশে পরিণত করে (.০১) অর্থাৎ ইহারা অন্যের দ্বারায় চালিত হইলেই চমৎকার কাজ করে বটে, কিন্তু অন্যকে চালনা করিলে সমস্ত মাটি করে। ইহারা এমন চমৎকার সৈন্য যে মন্দ সেনাপতিকেও জিতাইয়া দেয়, কিন্তু এমন খারাপ সেনাপতি যে ভাল সৈন্যদেরও হারাইয়া দেয়। স্ত্রী-মর্য্যাদা-অনভিজ্ঞ গোঁয়ারগণ বলেন যে, স্ত্রীলোকেরা এই শূন্য। ১এর সহিত যতক্ষণ তাহারা যুক্ত না হয় ততক্ষণ তাহারা শূন্য। কিন্তু ১এর সহিত বিধিমতে যুক্ত হইলে সে ১কে এমন বলীয়ান করিয়া তুলে যে, সে দশের কাজ করিতে পারে। কিন্তু এই শূন্যগণ যদি ১এর পূর্ব্বে চড়িয়া বসেন তবে এই ১বেচারীকে তাহার শতাংশে পরিণত করেন। স্ত্রৈণ পুরুষের আর এক নাম .০১। কিন্তু এই অযৌক্তিক লোকদের সঙ্গে আমি মিলি না।
সকলেই কিছু নিজের মাথা হইতে গড়িতে পারে না, এই জন্যই ছাঁচের আবশ্যক হয়। সকলেই কিছু কবি নহে, এই জন্য অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রয়োজন। গানের গলা অনেকেরই আছে, কিন্তু গানের প্রতিভা অল্প লোকেরই আছে, এই জন্যই অনেকেই গান গাহিতে পারেন না, রাগ রাগিণী গাহিতে পারেন। হৃদয়ের এমন একটা স্বভাব আছে, যে, যখনি তাহার ফুলবাগানে বসন্তের বাতাস বয় তখনি তার গাছে গাছে ডালে ডালে আপনি কুঁড়ি ধরে, আপনি ফুল ফুটিয়া উঠে। কিন্তু যার প্রাণে ফুলবাগান নাই, যার প্রাণে বসন্তের বাতাস বয় না, সে কি করে? সে প্যাটার্ণ কিনিয়া চোখে চশমা দিয়া পশমের ফুল তৈরি করে।