যখন দেখা হল তার সঙ্গে চোখে চোখে তখন আমার প্রথম বয়েস; সে আমাকে শুধাল, "তুমি খুঁজে বেড়াও কাকে?" আমি বললেম, "বিশ্বকবি তাঁর অসীম ছড়াটা থেকে একটা পদ ছিঁড়ে নিলেন কোন্ কৌতুকে, ভাসিয়ে দিলেন পৃথিবীর হাওয়ার স্রোতে, যেখানে ভেসে বেড়ায় ফুলের থেকে গন্ধ, বাঁশির থেকে ধ্বনি। ফিরছে সে মিলের পদটি পাবে ব'লে; তার মৌমাছির পাখায় বাজে খুঁজে বেড়াবার নীরব গুঞ্জরণ।" শুনে সে রইল চুপ করে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে। আমার মনে লাগল ব্যথা, বললেম, "কী ভাবছ তুমি?" ফুলের পাপড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে বললে,-- "কেমন করে জানবে তাকে পেলে কিনা, তোমার সেই অসংখ্যের মধ্যে একটিমাত্রকে।" আমি বললেম, "আমি যে খুঁজে বেড়াই সে তো আমার ছিন্ন জীবনের সবচেয়ে গোপন কথা; ও-কথা হঠাৎ আপনি ধরা পড়ে যার আপন বেদনায়, আমি জানি আমার গোপন মিল আছে তারি ভিতর।" কোনো কথা সে বলল না। কচি শ্যামল তার রঙটি; গলায় সরু সোনার হারগাছি, শরতের মেঘে লেগেছে ক্ষীণ রোদের রেখা। চোখে ছিল একটা দিশাহারা ভয়ের চমক পাছে কেউ পালায় তাকে না ব'লে। তার দুটি পায়ে ছিল দ্বিধা, ঠাহর পায়নি কোন্খানে সীমা তার আঙিনাতে। দেখা হল। সংসারে আনাগোনার পথের পাশে আমার প্রতীক্ষা ঐটুকু নিয়ে। তার পরে সে চলে গেছে।
বনস্পতি, তুমি যে ভীষণ ক্ষণে ক্ষণে আজিও তা মানে মোর মন। প্রকাণ্ড মাহাত্ম্যবলে জেনেছিলে ধরা একদিন যে আদি অরণ্যযুগে, আজি তাহা ক্ষীণ। মানুষের-বশ-মানা এই-যে তোমায় আজ দেখি, তোমার আপন রূপ এ কি? আমার বিধান দিয়ে বেঁধেছি তোমারে আমার বাসার চারি ধারে। ছায়া তব রেখেছি সংযমে। দাঁড়ায়ে রয়েছ স্তব্ধ জনতাসংগমে হাটের পথের ধারে। নম্র পত্রভারে কিংকরের মতো আছ মোর বিলাসের অনুগত। লীলাকাননের মাপে তোমারে করেছি খর্ব। মৃদু কলালাপে কর চিত্তবিনোদন, এ ভাষা কি তোমার আপন? একদিন এসেছিলে আদিবনভূমে; জীবলোক মগ্ন ঘুমে-- তখনো মেলে নি চোখ, দেখে নি আলোক। সমুদ্রের তীরে তীরে শাখায় মিলায়ে শাখা ধরার কঙ্কাল দিলে ঢাকা। ছায়ায় বুনিয়া ছায়া স্তরে স্তরে সবুজ মেঘের মতো ব্যাপ্ত হলে দিকে দিগন্তরে। লতায় গুল্মেতে ঘন, মৃতগাছ-শুষ্কপাতা-ভরা, আলোহীন পথহীন ধরা। অরণ্যের আর্দ্র গন্ধে নিবিড় বাতাস যেন রুদ্ধশ্বাস চলিতে না পারে। সিন্ধুর তরঙ্গধ্বনি অন্ধকারে গুমরিয়া উঠিতেছে জনশূন্য বিশ্বের বিলাপে। ভূমিকম্পে বনস্থলী কাঁপে; প্রচণ্ড নির্ঘোষে বহু তরুভার বহি বহুদূর মাটি যায় ধ্বসে গভীর পঙ্কের তলে। সেদিনের অন্ধযুগে পীড়িত সে জলে স্থলে তুমি তুলেছিলে মাথা। বলিতে বল্কলে তব গাঁথা সে ভীষণ যুগের আভাস। যেথা তব আদিবাস সে অরণ্যে একদিন মানুষ পশিল যবে দেখা দিয়েছিলে তুমি ভীতিরূপে তার অনুভবে। হে তুমি অমিত-আয়ু, তোমার উদ্দেশে স্তবগান করেছে সে। বাঁকাচোরা শাখা তব কত কী সংকেতে অন্ধকারে শঙ্কা রেখেছিল পেতে। বিকৃত বিরূপ মূর্তি মনে মনে দেখেছিল তারা তোমার দুর্গমে দিশাহারা। আদিম সে আরণ্যক ভয় রক্তে নিয়ে এসেছিনু আজিও সে কথা মনে হয়। বটের জটিল মূল আঁকাবাঁকা নেমে গেছে জলে-- মসীকৃষ্ণ ছায়াতলে দৃষ্টি মোর চলে যেত ভয়ের কৌতুকে, দুরু দুরু বুকে ফিরাতেম নয়ন তখনই। যে মূর্তি দেখেছি সেথা, শুনেছি যে ধ্বনি সে তো নহে আজিকার। বহু লক্ষ বর্ষ আগে সৃষ্টি সে তোমার। হে ভীষণ বনস্পতি, সেদিন যে নতি মন্ত্র পড়ি দিয়েছি তোমারে, আমার চৈতন্যতলে আজিও তা আছে এক ধারে।
প্রত্যুষে দেখিনু আজ নির্মল আলোকে নিখিলের শান্তি-অভিষেক, তরুগুলি নম্রশিরে ধরণীর নমস্কার করিল প্রচার। যে শান্তি বিশ্বের মর্মে ধ্রুব প্রতিষ্ঠিত, রক্ষা করিয়াছে তারে যুগ-যুগান্তের যত আঘাতে সংঘাতে। বিক্ষুব্ধ এ মর্তভূমে নিজের জানায় আবির্ভাব দিবসের আরম্ভে ও শেষে। তারি পত্র পেয়েছ তো কবি, মাঙ্গলিক। সে যদি অমান্য করে বিদ্রূপের বাহক সাজিয়া বিকৃতির সভাসদ্রূপে চিরনৈরাশ্যের দূত, ভাঙা যন্ত্রে বেসুর ঝংকারে ব্যঙ্গ করে এ বিশ্বের শাশ্বত সত্যেরে, তবে তার কোন্ আবশ্যক। শস্যক্ষেত্রে কাঁটাগাছ এসে অপমান করে কেন মানুষের অন্নের ক্ষুধারে। রুগ্ন যদি রোগেরে চরম সত্য বলে, তাহা নিয়ে স্পর্ধা করা লজ্জা বলে জানি-- তার চেয়ে বিনা বাক্যে আত্মহত্যা ভালো। মানুষের কবিত্বই হবে শেষে কলঙ্কভাজন অসংস্কৃত যদৃচ্ছের পথে চলি। মুখশ্রীর করিবে কি প্রতিবাদ মুখোশের নির্লজ্জ নকলে।