পথের নেশা আমায় লেগেছিল, পথ আমারে দিয়েছিল ডাক-- সূর্য তখন পূর্বগগনমূলে, নৌকা তখন বাঁধা নদীর কূলে, শিশির তখন শুকায় নিকো ফুলে, শিবালয়ে উঠল বেজে শাঁখ। পথের নেশা তখন লেগেছিল, পথ আমারে দিয়েছিল ডাক। আঁকাবাঁকা রাঙা মাটির লেখা ঘরছাড়া ওই নানা দেশের পথ-- প্রভাত-কালে অপার-পানে চেয়ে কী মোহগান উঠতেছিল গেয়ে, উদার সুরে ফেলতেছিল ছেয়ে বহুদূরের অরণ্য পর্বত। নানা দিনের নানা-পথিক-চলা ঘরছাড়া ওই নানা দেশের পথ। ভাবি নাইকো কেন কিসের লাগি ছুটে চলে এলেম পথের 'পরে। নিত্য কেবল এগিয়ে চলার সুখ, বাহির হওয়ার অনন্ত কৌতুক, প্রতি পদেই অন্তর উৎসুক অজানা কোন্ নিরুদ্দেশের তরে। ভোরের বেলা দুয়ার খুলে দিয়ে বাহির হয়ে এলেম পথের 'পরে। বেলা এখন অনেক হয়ে গেছে, পেরিয়ে চলে এলেম বহু দূর। ভেবেছিলেম পথের বাঁকে বাঁকে নব নব ভাগ্য আমায় ডাকে, হঠাৎ যেন দেখতে পাব কাকে, শুনতে যেন পাব নূতন সুর। তার পরে তো অনেক বেলা হল, পেরিয়ে চলে এলেম বহু দূর। অনেক দেখে ক্লান্ত এখন প্রাণ, ছেড়েছি সব অকস্মাতের আশা। এখন কেবল একটি পেলেই বাঁচি, এসেছি তাই ঘাটের কাছাকাছি-- এখন শুধু আকুল মনে যাচি তোমার পারে খেয়ার তরী ভাসা। জেনেছি আজ চলেছি কার লাগি ছেড়েছি সব অকস্মাতের আশা।
মাস্টারি-শাসনদুর্গে সিঁধকাটা ছেলে ক্লাসের কর্তব্য ফেলে জানি না কী টানে ছুটিতাম অন্দরের উপেক্ষিত নির্জন বাগানে। পুরোনো আমড়াগাছ হেলে আছে পাঁচিলের কাছে, দীর্ঘ আয়ু বহন করিছে তার পুঞ্জিত নিঃশব্দ স্মৃতি বসন্তবর্ষার। লোভ করি নাই তার ফলে, শুধু তার তলে সে সঙ্গরহস্য আমি করিতাম লাভ যার আবির্ভাব অলক্ষ্যে ব্যাপিয়া আছে সর্ব জলে স্থলে। পিঠ রাখি কুঞ্চিত বল্কলে যে পরশ লভিতাম জানি না তাহার কোনো নাম; হয়তো সে আদিম প্রাণের আতিথ্যদানের নিঃশব্দ আহ্বান, যে প্রথম প্রাণ একই বেগ জাগাইছে গোপন সঞ্চারে রসরক্তধারে মানবশিরায় আর তরুর তন্তুতে, একই স্পন্দনের ছন্দ উভয়ের অণুতে অণুতে। সেই মৌনী বনস্পতি সুবৃহৎ আলস্যের ছদ্মবেশে অলক্ষিতগতি সূক্ষ্ণ সম্বন্ধের জাল প্রসারিছে নিত্যই আকাশে, মাটিতে বাতাসে, লক্ষ লক্ষ পল্লবের পাত্র লয়ে তেজের ভোজের পানালয়ে। বিনা কাজে আমিও তেমনি বসে থাকি ছায়ায় একাকী, আলস্যের উৎস হতে চৈতন্যের বিবিধ দিগ্বাহী স্রোতে আমার সম্বন্ধ চরাচরে বিস্তারিছে অগোচরে কল্পনার সূত্রে বোনা জালে দূর দেশে দূর কালে। প্রাণে মিলাইতে প্রাণ সে বয়সে নাহি ছিল ব্যবধান; নিরুদ্ধ করে নি পথ ভাবনার স্তূপ; গাছের স্বরূপ সহজে অন্তর মোর করিত পরশ। অনাদৃত সে বাগান চায় নাই যশ উদ্যানের পদবীতে। তারে চিনাইতে মালীর নিপুণতার প্রয়োজন কিছু ছিল নাকো। যেন কী আদিম সাঁকো ছিল মোর মনে বিশ্বের অদৃশ্য পথে যাওয়ার আসার প্রয়োজনে। কুলগাছ দক্ষিণে কুয়োর ধারে, পুবদিকে নারিকেল সারে সারে, বাকি সব জঙ্গল আগাছা। একটা লাউয়ের মাচা কবে যত্নে ছিল কারো, ভাঙা চিহ্ন রেখে গেছে পাছে। বিশীর্ণ গোলকচাঁপা-গাছে পাতাশূন্য ডাল অভুগ্নের ক্লিষ্ট ইশারার মতো। বাঁধানো চাতাল; ফাটাফুটো মেঝে তার, তারি থেকে গরিব লতাটি যেত চোখে-না-পড়ার ফুলে ঢেকে। পাঁচিল ছ্যাৎলা-পড়া ছেলেমি খেয়ালে যেন রূপকথা গড়া কালের লেখনি-টানা নানামতো ছবির ইঙ্গিতে, সবুজে পাটলে আঁকা কালো সাদা রেখার ভঙ্গিতে। সদ্য ঘুম থেকে জাগা প্রতি প্রাতে নূতন করিয়া ভালো-লাগা ফুরাত না কিছুতেই। কিসে যে ভরিত মন সে তো জানা নেই। কোকিল দোয়েল টিয়ে এ বাগানে ছিল না কিছুই, কেবল চড়ুই, আর ছিল কাক। তার ডাক সময় চলার বোধ মনে এনে দিত। দশটা বেলার রোদ সে ডাকের সঙ্গে মিশে নারিকেল-ডালে দোলা খেত উদাস হাওয়ার তালে তালে। কালো অঙ্গে চটুলতা, গ্রীবাভঙ্গি, চাতুরী সতর্ক আঁখিকোণে, পরস্পর ডাকাডাকি ক্ষণে ক্ষণে-- এ রিক্ত বাগানটিরে দিয়েছিল বিশেষ কী দাম। দেখিতাম, আবছায়া ভাবনায় ভালোবাসিতাম।