ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে। নাস্তিক সেও পায়ে বিধাতার বর, ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর। শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো, শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো। বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে, নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে, পিতার নামেতে হানে তাঁর সন্তানে, আচার লইয়া বিচার নাহিকো জানে, পূজাগৃহে তোলে রক্তমাখানো ধ্বজা, -- দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা। অনেক যুগের লজ্জা ও লাঞ্ছনা, বর্বরতার বিকারবিড়ম্বনা ধর্মের মাঝে আশ্রয় দিল যারা আবর্জনায় রচে তারা নিজ কারা। -- প্রলয়ের ওই শুনি শৃঙ্গধ্বনি, মহাকাল আসে লয়ে সম্মার্জনী। যে দেবে মুক্তি তারে খুঁটিরূপে গাড়া, যে মিলাবে তারে করিল ভেদের খাঁড়া, যে আনিবে প্রেম অমৃত-উৎস হতে তারি নামে ধরা ভাসায় বিষের স্রোতে, তরী ফুটা করি পার হতে গিয়ে ডোবে -- তবু এরা কারে অপবাদ দেয় ক্ষোভে। হে ধর্মরাজ, ধর্মবিকার নাশি ধর্মমূঢ়জনেরে বাঁচাও আসি। যে পূজার বেদি রক্তে গিয়েছে ভেসে ভাঙো ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে -- ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো, এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।
লিখতে যখন বল আমায় তোমার খাতার প্রথম পাতে তখন জানি, কাঁচা কলম নাচবে আজও আমার হাতে,- সেই কলমে আছে মিশে ভাদ্র মাসের কাশের হাসি, সেই কলমে সাঁঝের মেঘে লুকিয়ে বাজে ভোরের বাঁশি। সেই কলমে শিশু দোয়েল শিস দিয়ে তার বেড়ায় উড়ি। পারুলদিদির বাসায় দোলে কনকচাঁপার কচি কুঁড়ি। খেলার পুতুল আজও আছে সেই কলমের খেলাঘরে, সেই কলমে পথ কেটে দেয় পথ-হারানো তেপান্তরে। নতুন চিকন অশথপাতা সেই কলমে আপনি নাচে। সেই কলমে মোর বয়সে তোমার বয়স বাঁধা আছে।
যে পলায়নের অসীম তরণী বাহিছে সূর্যতারা সেই পলায়নে দিবসরজনী ছুটেছ গঙ্গাধারা। চিরধাবমান নিখিলবিশ্ব এ পলায়নের বিপুল দৃশ্য, এই পলায়নে ভূত ভবিষ্য দীক্ষিছে ধরণীরে। জলের ছায়া সে দ্রুততালে বয়, কঠিন ছায়া সে ওই লোকালয়, একই প্রলয়ের বিভিন্ন লয় স্থিরে আর অস্থিরে। সৃষ্টি যখন আছিল নবীন নবীনতা নিয়ে এলে, ছেলেমানুষির স্রোতে নিশিদিন চল অকারণ খেলে। লীলাছলে তুমি চিরপথহারা, বন্ধনহীন নৃত্যের ধারা, তোমার কুলেতে সীমা দিয়ে কারা বাঁধন গড়িছে মিছে। আবাঁধা ছন্দে হেসে যাও সরি পাথরের মুঠি শিথিলিত করি, বাঁধাছন্দের নগরনগরী ধুলায় মিলায় পিছে। অচঞ্চলের অমৃত বরিষে চঞ্চলতার নাচে, বিশ্বলীলা তো দেখি কেবলি সে নেই নেই ক'রে আছে। ভিত ফেঁদে যারা তুলিছে দেয়াল তারা বিধাতার মানে না খেয়াল, তারা বুঝিল না-- অনন্তকাল অচির কালেরই মেলা। বিজয়তোরণ গাঁথে তারা যত আপনার ভারে ভেঙে পড়ে তত, খেলা করে কাল বালকের মতো লয়ে তার ভাঙা ঢেলা। ওরে মন, তুই চিন্তার টানে বাঁধিস নে আপনারে, এই বিশ্বের সুদূর ভাসানে অনায়াসে ভেসে যা রে। কী গেছে তোমার কী রয়েছে আর নাই ঠাঁই তার হিসাব রাখার, কী ঘটিতে পারে জবাব তাহার নাই বা মিলিল কোনো। ফেলিতে ফেলিতে যাহা ঠেকে হাতে তাই পরশিয়া চলো দিনে রাতে, যে সুর বাজিল মিলাতে মিলাতে তাই কান দিয়ে শোনো। এর বেশি যদি আরো কিছু চাও দুঃখই তাহে মেলে। যেটুকু পেয়েছে তাই যদি পাও তাই নাও, দাও ফেলে। যুগ যুগ ধরি জেনো মহাকাল চলার নেশায় হয়েছে মাতাল, ডুবিছে ভাসিছে আকাশ পাতাল আলোক আঁধার বহি। দাঁড়াবে না কিছু তব আহ্বানে, ফিরিয়া কিছু না চাবে তোমা-পানে, ভেসে যদি যাও যাবে একখানে সকলের সাথে রহি।