হাটের ভিড়ের দিকে চেয়ে দেখি, হাজার হাজার মুখ হাজার হাজার ইতিহাস ঢাকা দিয়ে আসে যায় দিনের আলোয় রাতের আঁধারে। সব কথা তার কোনো কালে জানবে না কেউ, নিজেও জানে না কোনো লোক। মুখর আলাপ তার, উচ্চস্বরে কত আলোচনা, তারি অন্তস্তলে বিচিত্র বিপুল স্মৃতিবিস্মৃতির সৃষ্টিরাশি। সেখানে তো শব্দ নেই আলো নেই, বাইরের দৃষ্টি নেই, প্রবেশের পথ নেই কারো। সংখ্যাহীন মানুষের এই যে প্রচ্ছন্ন বাণী, অশ্রুত কাহিনী কোন্ আদিকাল হতে অন্তঃশীল অগণ্য ধারায় আঁধার মৃত্যুর মাঝে মেশে রাত্রিদিন, কী হল তাদের, কী এদের কাজ। হে প্রিয়, তোমার যতটুকু দেখেছি শুনেছি জেনেছি, পেয়েছি স্পর্শ করি' -- তার বহুশতগুণ অদৃশ্য অশ্রুত রহস্য কিসের জন্য বন্ধ হয়ে আছে, কার অপেক্ষায়। সে নিরালা ভবনের কুলুপ তোমার কাছে নেই। কার কাছে আছে তবে। কে মহা-অপরিচিত যার অগোচর সভাতলে হে চেনা-অপরিচিত, তোমার আসন? সেই কি সবার চেয়ে জানে আমাদের অন্তরের অজানারে। সবার চেয়ে কি বড়ো তার ভালোবাসা যার শুভদৃষ্টি-কাছে অব্যক্ত করেছে অবগুণ্ঠন মোচন।
শালিখটার কী হল তাই ভাবি। একলা কেন থাকে দলছাড়া। প্রথম দিন দেখেছিলেম শিমুল গাছের তলায়, আমার বাগানে, মনে হল একটু যেন খুঁড়িয়ে চলে। তার পরে ওই রোজ সকালে দেখি-- সঙ্গীহারা, বেড়ায় পোকা শিকার ক'রে। উঠে আসে আমার বারান্দায়-- নেচে নেচে করে সে পায়চারি, আমার 'পরে একটুকু নেই ভয়। কেন এমন দশা। সমাজের কোন্ শাসনে নির্বাসনের পালা, দলের কোন্ অবিচারে জাগল অভিমান। কিছু দূরেই শালিখগুলো করছে বকাবকি, ঘাসে ঘাসে তাদের লাফালাফি, উড়ে বেড়ায় শিরীষ গাছের ডালে ডালে-- ওর দেখি তো খেয়াল কিছুই নেই। জীবনে ওর কোন্খানে যে গাঁঠ পড়েছে সেই কথাটাই ভাবি। সকালবেলার রোদে যেন সহজ মনে আহার খুঁটে খুঁটে ঝরে-পড়া পাতার উপর লাফিয়ে বেড়ায় সারাবেলা। কারো উপর নালিশ কিছু আছে মনে হয় না একটুও তা। বৈরাগ্যের গর্ব তো নেই ওর চলনে, কিম্বা দুটো আগুন-জ্বলা চোখ। কিন্তু ওকে দেখি নি তো সন্ধেবেলায়-- একলা যখন যায় বাসাতে ডালের কোণে, ঝিল্লি যখন ঝিঁ ঝিঁ করে অন্ধকারে, হাওয়ায় আসে বাঁশের পাতার ঝর্ঝরানি। গাছের ফাঁকে তাকিয়ে থাকে ঘুমভাঙানো সঙ্গীবিহীন সন্ধ্যাতারা।