এ সংসারে আছে বহু অপরাধ, হেন অপবাদ যখন ঘোষণা কর উচ্চ হতে উষ্ণ উচ্চারণে, ভাবি মনে মনে, ক্রোধের উত্তাপ তার তোমার আপন অহংকার। মন্দ ও ভালোর দ্বন্দ্ব, কে না জানে চিরকাল আছে সৃষ্টির মর্মের কাছে। না যদি সে রহে বিশ্ব ঘেরি বিরুদ্ধ নির্ঘাতবেগে বাজে না শ্রেষ্ঠের জয়ভেরী। বিধাতার 'পরে মিথ্যা আনিয়ো না অভিযোগ মৃত্যুদুঃখ কর যবে ভোগ; মনে জেনো, মৃত্যুর মূল্যেই করি ক্রয় এ জীবনে দুর্মূল্য যা, অমর্ত যা, যা-কিছু অক্ষয়। ভাঙনের আক্রমণ সৃষ্টিকর্তা মানুষেরে আহ্বান করিছে অনুক্ষণ। দুর্গমের বক্ষে থাকে দয়াহীন শ্রেয়, রুদ্রতীর্থযাত্রীর পাথেয়। বহুভাগ্য সেই জন্মিয়াছি এমন বিশ্বেই নির্দোষ যা নয়। দুঃখ লজ্জা ভয় ছিন্ন সূত্রে জটিল গ্রন্থিতে রচনার সামঞ্জস্য পদে পদে রয়েছে খণ্ডিতে। এই ত্রুটি দেখেছি যখন শুনি নি কি সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী গভীর ক্রন্দন যুগে যুগে উচ্ছ্বসিতে থাকে; দেখি নি কি আর্তচিত্ত উদ্বোধিয়া রাখে মানুষের ইতিবৃত্ত বেদনার নিত্য আন্দোলনে? উৎপীড়িত সেই জাগরণে তন্দ্রাহীন যে-মহিমা যাত্রা করে রাত্রির আঁধারে নমস্কার জানাই তাহারে। নানা নামে আসিছে সে নানা অস্ত্র হাতে কন্টকিত অসম্মান অবাধে দলিয়া পদপাতে-- মরণেরে হানি-- প্রলয়ের পান্থ সেই, রক্ত মোর তাহারে আহ্বানি।
প্রথম তোমাকে দেখেছি তোমার বোনের বিয়ের বাসরে নিমন্ত্রণের আসরে। সেদিন তখনো দেখেও তোমাকে দেখি নি, তুমি যেন ছিলে সূক্ষ্মরেখিণী ছবির মতো-- পেন্সিলে-আঁকা ঝাপসা ধোঁয়াটে লাইনে চেহারার ঠিক ভিতর দিকের সন্ধানটুকু পাই নে। নিজের মনের রঙ মেলাবার বাটিতে চাঁপালি খড়ির মাটিতে গোলাপি খড়ির রঙ হয় নি যে গোলা, সোনালি রঙের মোড়ক হয় নি খোলা। দিনে দিনে শেষে সময় এসেছে আগিয়ে, তোমার ছবিতে আমারি মনের রঙ যে দিয়েছি লাগিয়ে। বিধাতা তোমাকে সৃষ্টি করতে এসে আনমনা হয়ে শেষে কেবল তোমার ছায়া রচে দিয়ে, ভুলে ফেলে গিয়েছেন-- শুরু করেন নি কায়া। যদি শেষ করে দিতেন, হয়তো হত সে তিলোত্তমা, একেবারে নিরুপমা। যত রাজ্যের যত কবি তাকে ছন্দের ঘের দিয়ে আপন বুলিটি শিখিয়ে করত কাব্যের পোষা টিয়ে। আমার মনের স্বপ্নে তোমাকে যেমনি দিয়েছি দেহ অমনি তখন নাগাল পায় না সাহিত্যিকেরা কেহ। আমার দৃষ্টি তোমার সৃষ্টি হয়ে গেল একাকার। মাঝখান থেকে বিশ্বপতির ঘুচে গেল অধিকার। তুমি যে কেমন আমিই কেবল জানি, কোনো সাধারণ বাণী লাগে না কোনোই কাজে। কেবল তোমার নাম ধ'রে মাঝে-মাঝে অসময়ে দিই ডাক, কোনো প্রয়োজন থাক্ বা নাই-বা থাক্। অমনি তখনি কাঠিতে-জড়ানো উলে হাত কেঁপে গিয়ে গুন্তিতে যাও ভুলে। কোনো কথা আর নাই কোনো অভিধানে যার এত বড়ো মানে।
লিখন দিয়ে স্মৃতিরে কি রাখবে চিরদিন? লিখন রবে, স্মৃতি হবে কোন্ আঁধারে লীন। পাখির সময় হলে সে কি মান্বে খাঁচার মানা-- রইবে না সে, রবে কেবল লোহার খাঁচাখানা।