মৃত্যুর পাত্রে খৃস্ট যেদিন মূত্যুহীন প্রাণ উৎসর্গ করলেন রবাহূত অনাহূতের জন্যে, তার পরে কেটে গেছে বহু শত বৎসর। আজ তিনি একবার নেমে এলেন নিত্যধাম থেকে মর্তধামে। চেয়ে দেখলেন, সেকালেও মানুষ ক্ষতবিক্ষত হত যে-সমস্ত পাপের মারে-- যে উদ্ধত শেল ও শল্য, যে চতুর ছোরা ও ছুরি, যে ক্রূর কুটিল তলোয়ারের আঘাতে-- বিদ্যুদ্বেগে আজ তাদের ফলায় শান দেওয়া হচ্ছে হিস্হিস্ শব্দে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে বড়ো বড়ো মসীধূমকেতন কারখানাঘরে। কিন্তু দারুণতম যে মৃত্যুবাণ নূতন তৈরি হল, ঝক্ঝক্ করে উঠল নরঘাতকের হাতে, পূজারি তাতে লাগিয়েছে তাঁরই নামের ছাপ তীক্ষ্ণ নখে আঁচড় দিয়ে। খৃস্ট বুকে হাত চেপে ধরলেন; বুঝলেন শেষ হয় নি তাঁর নিরবচ্ছিন্ন মৃত্যুর মুহূর্ত, নূতন শূল তৈরি হচ্ছে বিজ্ঞানশালায়-- বিঁধছে তাঁর গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে। সেদিন তাঁকে মেরেছিল যারা ধর্মমন্দিরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, তারাই আজ নূতন জন্ম নিল দলে দলে, তারাই আজ ধর্মমন্দিরের বেদীর সামনে থেকে পূজামন্ত্রের সুরে ডাকছে ঘাতক সৈন্যকে-- বলছে "মারো মারো'। মানবপুত্র যন্ত্রণায় বলে উঠলেন ঊর্ধ্বে চেয়ে, "হে ঈশ্বর, হে মানুষের ঈশ্বর, কেন আমাকে ত্যাগ করলে।'
ইহাদের করো আশীর্বাদ। ধরায় উঠেছে ফুটি শুভ্র প্রাণগুলি, নন্দনের এনেছে সম্বাদ, ইহাদের করো আশীর্বাদ। ছোটো ছোটো হাসিমুখ জানে না ধরার দুখ, হেসে আসে তোমাদের দ্বারে। নবীন নয়ন তুলিকৌতুকেতে দুলি দুলি চেয়ে চেয়ে দেখে চারি ধারে। সোনার রবির আলো কত তার লাগে ভালো, ভালো লাগে মায়ের বদন। হেথায় এসেছে ভুলি, ধুলিরে জানে না ধূলি, সবই তার আপনার ধন। কোলে তুলে লও এরে -- এ যেন কেঁদে না ফেরে, হরষেতে না ঘটে বিষাদ। বুকের মাঝারে নিয়ে পরিপূর্ণ প্রাণ দিয়ে ইহাদের করো আশীর্বাদ। নূতন প্রবাসে এসে সহস্র পথের দেশে নীরবে চাহিছে চারি ভিতে। এত শত লোক আছে, এসেছে তোমারি কাছে সংসারের পথ শুধাইতে। যেথা তুমি লয়ে যাবে কথাটি না কয়ে যাবে, সাথে যাবে ছায়ার মতন, তাই বলি, দেখো দেখো, এ বিশ্বাস রেখো রেখো, পাথারে দিয়ো না বিসর্জন। ক্ষুদ্র এ মাথার 'পর রাখো গো করুণ কর, ইহারে কোরো না অবহেলা। এ ঘোর সংসার-মাঝে এসেছে কঠিন কাজে, আসে নি করিতে শুধু খেলা। দেখে মুখশতদল চোখে মোর আসে জল, মনে হয় বাঁচিবে না বুঝি -- পাছে সুকুমার প্রাণ ছিঁড়ে হয় খান্-খান্ জীবনের পারাবারে বুঝি। এই হাসিমুখগুলি হাসি পাছে যায় ভুলি, পাছে ঘেরে আঁধার প্রমাদ! উহাদের কাছে ডেকে বুকে রেখে কোলে রেখে তোমরা করো গো আশীর্বাদ। বলো, "সুখে যাও চ'লে ভবের তরঙ্গ দ'লে, স্বর্গ হতে আসুক বাতাস। সুখদুঃখ কোরো হেলা, সে কেবল ঢেউ-খেলা নাচিবে তোদের চারি পাশ।'