চিঠি কই! দিন গেল বইগুলো ছুঁড়ে ফেলো, আর তো লাগে না ভালো ছাইপাঁশ পড়া। মিটায়ে মনের খেদ গেঁথে গেছে অবিচ্ছেদ পরিচ্ছেদে পরিচ্ছেদ মিছে মন-গড়া। কাননপ্রান্তের কাছে ছায়া পড়ে গাছে গাছে, ম্লান আলো শুয়ে আছে বালুকার তীরে। বায়ু উঠে ঢেউ তুলি, টলমল পড়ে দুলি কূলে বাঁধা নৌকাগুলি জাহ্নবীর নীরে। চিঠি কই! হেথা এসে একা বসে দূর দেশে কী পড়িব দিন শেষে সন্ধ্যার আলোকে! গোধূলির ছায়াতলে কে বলো গো মায়াবলে সেই মুখ অশ্রুজলে এঁকে দেবে চোখে। গভীর গুঞ্জনস্বনে ঝিল্লিরব উঠে বনে, কে মিশাবে তারি সনে স্মৃতিকণ্ঠস্বর। তীরতরু-ছায়ে-ছায়ে কোমল সন্ধ্যার বায়ে কে আনিয়া দিবে গায়ে সুকোমল কর। পাখি তরুশিরে আসে, দূর হতে নীড়ে আসে, তরীগুলি তীরে আসে, ফিরে আসে সবে-- তার সেই স্নেহস্বর ভেদি দূর-দূরান্তর কেন এ কোলের 'পরে আসে না নীরবে! দিনান্তে স্নেহের স্মৃতি একবার আসে নিতি কলরব-ভরা প্রীতি লয়ে তার মুখে-- দিবসের ভার যত তবে হয় অপগত, নিশি নিমেষের মতো কাটে স্বপ্নসুখে। সকলি তো মনে আছে যতদিন ছিল কাছে কত কথা বলিয়াছে কত ভালোবেশে-- কত কথা শুনি নাই হৃদয়ে পায় নি ঠাঁই, মুহূর্ত শুনিয়া তাই ভুলেছি নিমেষে। পাতা পোরাবার ছলে আজ সে যা-কিছু বলে তাই-শুনে মন গলে, চোখে আসে জল-- তারি লাগি কত ব্যথা, কত মনোব্যাকুলতা, দু-চারিটি তুচ্ছ কথা জীবনসম্বল। দিবা যেন আলোহীনা এই দুটি কথা বিনা "তুমি ভালো আছ কি না' "আমি ভালো আছি'। স্নেহ যেন নাম ডেকে কাছে এসে যায় দেখে, দুটি কথা দূর থেকে করে কাছাকাছি। দরশ পরশ যত সকল বন্ধন গত, মাঝে ব্যবধান কত নদীগিরিপারে-- স্মৃতি শুধু স্নেহ বয়ে দুঁহু করস্পর্শ লয়ে অক্ষরের মালা হয়ে বাঁধে দুজনারে। কই চিঠি! এল নিশা, তিমিরে ডুবিল দিশা, সারা দিবসের তৃষা রয়ে গেল মনে-- অন্ধকার নদীতীরে বেড়াতেছি ফিরে ফিরে, প্রকৃতির শান্তি ধীরে পশিছে জীবনে। ক্রমে আঁখি ছলছল্, দুটি ফোঁটা অশ্রুজল ভিজায় কপোলতল, শুকায় বাতাসে-- ক্রমে অশ্রু নাহি বয়, ললাট শীতল হয় রজনীর শান্তিময় শীতল নিশ্বাসে। আকাশে অসংখ্য তারা চিন্তাহারা ক্লান্তিহারা হৃদয় বিস্ময়ে সারা হেরি একদিঠি-- আর যে আসে না আসে মুক্ত এই মহাকাশে প্রতি সন্ধ্যা পরকাশে অসীমের চিঠি। অনন্ত বারতা বহে, অন্ধকার হতে কহে, "যে রহে যে নাহি রহে কেহ নহে একা-- সীমাপরপারে থাকি সেথা হতে সবে ডাকি প্রতি রাত্রে লিখে রাখি জ্যোতিপত্রলেখা।"
মনে ভাবিতেছি, যেন অসংখ্য ভাষার শব্দরাজি ছাড়া পেল আজি, দীর্ঘকাল ব্যাকরণদুর্গে বন্দী রহি অকস্মাৎ সারি সারি কুচকাওয়াজের পদক্ষেপে উঠেছে অধীর হয়ে খেপে। লঙ্ঘিয়াছে বাক্যের শাসন, নিয়েছে অবুদ্ধিলোকে অবদ্ধ ভাষণ, ছিন্ন করি অর্থের শৃঙ্খলপাশ সাধুসাহিত্যের প্রতি ব্যঙ্গহাস্যে হানে পরিহাসল সব ছেড়ে অধিকার করে শুধু শ্রুতি — বিচিত্র তাদের ভঙ্গি, বিচিত্র আকূতি। বলে তারা, আমরা যে এই ধরণীর নিশ্বসিত পবনের আদিম ধ্বনির জন্মেছি সন্তান, যখনি মানবকন্ঠে মনোহীন প্রাণ নাড়ীর দোলায় সদ্য জেগেছে নাচিয়া উঠেছি বাঁচিয়া। শিশুকন্ঠে আদিকাব্যে এনেছি উচ্ছলি অস্তিত্বের প্রথম কাকলি। গিরিশিরে যে পাগল-ঝোরা শ্রাবণের দূত, তারি আত্মীয় আমরা আসিয়াছি লোকালয়ে সৃষ্টির ধ্বনির মন্ত্র লয়ে। মর্মরমুখর বেগে যে ধ্বনির কলোৎসব অরণ্যের পল্লবে পল্লবে, যে ধ্বনি দিগন্তে করে ঝড়ের ছন্দের পরিমাপ, নিশান্তের জাগায় যাহা প্রভাতের প্রকান্ড প্রলাপ, সে ধ্বনির ক্ষেত্র হতে হরিয়া করেছে পদানত বন্য ঘোটকের মতো মানুষ শব্দেরে তার জটিল নিয়মসূত্রজালে বার্তাবহনের লাগি অনাগত দূর দেশে কালে। বল্গাবদ্ধ-শব্দ-অশ্বে চড়ি মানুষ করেছে দ্রুত কালের মন্থর যত ঘড়ি। জড়ের অচল বাধা তর্কবেগে করিয়া হরণ অদৃশ্য রহস্যলোকে গহনে করেছে সঞ্চরণ, ব্যূহে বঁধি শব্দ-অক্ষৌহিণী প্রতি ক্ষণে মূঢ়তার আক্রমণ লইতেছি জিনি। কখনো চোরের মতো পশে ওরা স্বপ্নরাজ্যতলে, ঘুমের ভাটার জলে নাহি পায় বাধা — যাহা-তাহা নিয়ে আসে, ছন্দের বাঁধনে পড়ে বাঁধা, তাই দিয়ে বুদ্ধি অন্যমনা করে সেই শিল্পের রচনা সূত্র যার অসংলগ্ন স্খলিত শিথিল, বিধির সৃষ্টির সাথে নারাখে একান্ত তার মিল; যেমন মাতিয়া উঠে দশ-বিশ কুকুরের ছানা — এ ওর ঘাড়েতে চড়ে, কোনো উদ্দ্যেশ্যের নাই মানা, কে কাহারে লাগায় কামড়, জাগায় ভীষণ শব্দে গর্জনের ঝড়, সে কামড়ে সে গর্জনে কোনো অর্থ নাই হিংস্রতার, উদ্দাম হইয়া উঠে শুধু ধ্নি শুধু ভঙ্গি তার। মনে মনে দেখিতেছি, সারা বেলা ধরি দলে দলে শব্দ ছোটে অর্থ ছিন্ন করি — আকাশে আকাশে যেন বাজে, আগ্ডুম বাগ্ডুম ঘোড়াডুম সাজে।
এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে হবে গো এইবার-- আমার এই মলিন অহংকার। দিনের কাজে ধুলা লাগি অনেক দাগে হল দাগি, এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার। আমার এই মলিন অহংকার। এখন তো কাজ সাঙ্গ হল দিনের অবসানে, হল রে তাঁর আসার সময় আশা এল প্রাণে। স্নান করে আয় এখন তবে প্রেমের বসন পরতে হবে, সন্ধ্যাবনের কুসুম তুলে গাঁথতে হবে হার। ওরে আয় সময় নেই যে আর।