সারারাত ধ'রে গোছা গোছা কলাপাতা আসে গাড়ি ভ'রে। আসে সরা খুরি ভূরি ভূরি। এপাড়া ওপাড়া হতে যত রবাহূত অনাহূত আসে শত শত; প্রবেশ পাবার তরে ভোজনের ঘরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঠেলাঠেলি করে; ব'সে পড়ে যে পারে যেখানে, নিষেধ না মানে। কে কাহারে হাঁক ছাড়ে হৈ হৈ, এ কই, ও কই। রঙিন উষ্ণীষধর লালরঙা সাজে যত অনুচর অনর্থক ব্যস্ততায় ফেরে সবে আপনার দায়িত্বগৌরবে। গোরুর গাড়ির সারি হাটের রাস্তায়, রাশি রাশি ধুলো উড়ে যায়, রাঙা রাগে রৌদ্রে গেরুয়া রঙ লাগে। ওদিকে ধানের কল দিগন্তে কালিমাধূম্র হাত ঊর্ধ্বে তুলি, কলঙ্কিত করিছে প্রভাত। ধান-পচানির গন্ধে বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশাইছে বিষ। থেকে থেকে রেলগাড়ি মাঠের ওপারে দেয় শিস। দুই প্রহরের ঘণ্টা বাজে। সমস্ত এ ছন্দভাঙা অসংগতি-মাঝে সানাই লাগায় তার সারঙের তান। কী নিবিড় ঐক্যমন্ত্র করিছে সে দান কোন্ উদ্ভ্রান্তের কাছে, বুঝিবার সময় কি আছে। অরূপের মর্ম হতে সমুচ্ছ্বাসি উৎসবের মধুচ্ছন্দ বিস্তারিছে বাঁশি। সন্ধ্যাতারা-জ্বালা অন্ধকারে অনন্তের বিরাট পরশ যথা অন্তর-মাঝারে, তেমনি সুদূর স্বচ্ছ সুর গভীর মধুর অমর্ত লোকের কোন্ বাক্যের অতীত সত্যবাণী অন্যমনা ধরণীর কানে দেয় আনি। নামিতে নামিতে এই আনন্দের ধারা বেদনার মূর্ছনায় হয় আত্মহারা। বসন্তের যে দীর্ঘনিশ্বাস বিকচ বকুলে আনে বিদায়ের বিমর্ষ আভাস, সংশয়ের আবেগ কাঁপায় সদ্যঃপাতী শিথিল চাঁপায়, তারি স্পর্শ লেগে সাহানার রাগিণীতে বৈরাগিণী ওঠে যেন জেগে, চলে যায় পথহারা অর্থহারা দিগন্তের পানে। কতবার মনে ভাবি, কী যে সে কে জানে। মনে হয়, বিশ্বের যে মূল উৎস হতে সৃষ্টির নির্ঝর ঝরে শূন্যে শূন্যে কোটি কোটি স্রোতে এ রাগিণী সেথা হতে আপন ছন্দের পিছু পিছু নিয়ে আসে বস্তুর অতীত কিছু হেন ইন্দ্রজাল যার সুর যার তাল রূপে রূপে পূর্ণ হয়ে উঠে কালের অঞ্জলিপুটে। প্রথম যুগের সেই ধ্বনি শিরায় শিরায় উঠে রণরণি; মনে ভাবি, এই সুর প্রত্যহের অবরোধ-'পরে যতবার গভীর আঘাত করে ততবার ধীরে ধীরে কিছু কিছু খুলে দিয়ে যায় ভাবী যুগ-আরম্ভের অজানা পর্যায়। নিকটের দুঃখদ্বন্দ্ব নিকটের অপূর্ণতা তাই সব ভুলে যাই, মন যেন ফিরে সেই অলক্ষ্যের তীরে তীরে যেথাকার রাত্রিদিন দিনহারা রাতে পদ্মের কোরক-সম প্রচ্ছন্ন রয়েছে আপনাতে।
অলস সময়-ধারা বেয়ে মন চলে শূন্য-পানে চেয়ে। সে মহাশূন্যের পথে ছায়া-আঁকা ছবি পড়ে চোখে। কত কাল দলে দলে গেছে কত লোকে সুদীর্ঘ অতীতে জয়োদ্ধত প্রবল গতিতে। এসেছে সাম্রাজ্যলোভী পাঠানের দল, এসেছে মোগল; বিজয়রথের চাকা উড়ায়েছে ধূলিজাল,উড়িয়াছে বিজয়পতাকা। শূন্যপথে চাই, আজ তার কোনো চিহ্ন নাই। নির্মল সে নীলিমায় প্রভাতে ও সন্ধ্যায় রাঙালো যুগে যুগে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আলো। আরবার সেই শূন্যতলে আসিয়াছে দলে দলে লৌহবাঁধা পথে অনলনিশ্বাসী রথে প্রবল ইংরেজ, বিকীর্ণ করেছে তার তেজ। জানি তারো পথ দিয়ে বয়ে যাবে কাল, কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশবেড়া জাল; জানি তার পণ্যবাহী সেনা জ্যোতিষ্কলোকের পথে রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না। মাটির পৃথিবী-পানে আঁখি মেলি যবে দেখি সেথা কলকলরবে বিপুল জনতা চলে নানা পথে নানা দলে দলে যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে জীবনে মরণে। ওরা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল, ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে। ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে। রাজছত্র ভেঙে পড়ে,রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে, জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে, রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত-আঁখি শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি। ওরা কাজ করে দেশে দেশান্তরে, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে, পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে। গুরুগুরু গর্জন গুন্গুন্ স্বর দিনরাত্রে গাঁথা পড়ি দিনযাত্রা করিছে মুখর। দুঃখ সুখ দিবসরজনী মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি। শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-'পরে ওরা কাজ করে।