কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া, এসেছি ভুলে। তবু একবার চাও মুখপানে নয়ন তুলে। দেখি, ও নয়নে নিমেষের তরে সেদিনের ছায়া পড়ে কি না পড়ে, সজল আবেগে আঁখিপাতা দুটি পড়ে কি ঢুলে। ক্ষণেকের তরে ভুল ভাঙায়ো না, এসেছি ভুলে। বেল-কুঁড়ি দুটি করে ফুটি-ফুটি অধর খোলা। মনে পড়ে গেল সেকালের সেই কুসুম তোলা। সেই শুকতারা সেই চোখে চায়, বাতাস কাহারে খুঁজিয়া বেড়ায়, উষা না ফুটিতে হাসি ফুটে তার গগনমূলে। সেদিন যে গেছে ভুলে গেছি, তাই এসেছি ভুলে। ব্যথা দিয়ে কবে কথা কয়েছিলে পড়ে না মনে, দূরে থেকে কবে ফিরে গিয়েছিলে নাই স্মরণে। শুধু মনে পড়ে হাসিমুখখানি, লাজে বাধো-বাধো সোহাগের বাণী, মনে পড়ে সেই হৃদয়-উছাস নয়ন-কূলে। তুমি যে ভুলেছ ভুলে গেছি, তাই এসেছি ভুলে। কাননের ফুল, এরা তো ভোলে নি, আমরা ভুলি? সেই তো ফুটেছে পাতায় পাতায় কামিনীগুলি। চাঁপা কোথা হতে এনেছে ধরিয়া অরুণকিরণ কোমল করিয়া, বকুল ঝরিয়া মরিবারে চায় কাহার চুলে? কেহ ভোলে, কেউ ভোলে না যে, তাই এসেছি ভুলে। এমন করিয়া কেমনে কাটিবে মাধবী রাতি? দখিনে বাতাসে কেহ নেই পাশে সাথের সাথি। চারি দিক হতে বাঁশি শোনা যায়, সুখে আছে যারা তারা গান গায়-- আকুল বাতাসে, মদির সুবাসে, বিকচ ফুলে, এখনো কি কেঁদে চাহিবে না কেউ আসিলে ভুলে?
বেলা আটটার কমে খোলে না তো চোখ সে। সামলাতে পারে না যে নিদ্রার ঝোঁক সে। জরিমানা হলে বলে,-- 'এসেছি যে মা ফেলে, আমার চলে না দিন মাইনেটা না পেলে। তোমার চলবে কাজ যে ক'রেই হোক সে, আমারে অচল করে মাইনের শোক সে।'
তখন নিশীথরাত্রি; গেলে ঘর হতে যে পথে চল নি কভু সে অজানা পথে। যাবার বেলায় কোনো বলিলে না কথা, লইয়া গেলে না কারো বিদায়বারতা। সুপ্তিমগ্ন বিশ্ব-মাঝে বাহিরিলে একা-- অন্ধকারে খুঁজিলাম, না পেলাম দেখা। মঙ্গলমুরতি সেই চিরপরিচিত অগণ্য তারার মাঝে কোথায় অন্তর্হিত! গেলে যদি একেবারে গেলে রিক্ত হাতে? এ ঘর হইতে কিছু নিলে না কি সাথে? বিশ বৎসরের তব সুখদুঃখভার ফেলে রেখে দিয়ে গেলে কোলেতে আমার! প্রতিদিবসের প্রেমে কতদিন ধরে যে ঘর বাঁধিলে তুমি সুমঙ্গল-করে পরিপূর্ণ করি তারে স্নেহের সঞ্চয়ে, আজ তুমি চলে গেলে কিছু নাহি লয়ে? তোমার সংসার-মাঝে, হায়, তোমা-হীন এখনো আসিবে কত সুদিন-দুর্দিন-- তখন এ শূন্য ঘরে চিরাভ্যাস-টানে তোমারে খুঁজিতে এসে চাব কার পানে? আজ শুধু এক প্রশ্ন মোর মনে জাগে-- হে কল্যাণী, গেলে যদি, গেলে মোর আগে, মোর লাগি কোথাও কি দুটি স্নিগ্ধ করে রাখিবে পাতিয়া শয্যা চিরসন্ধ্যা-তরে?