মনে করি এইখানে শেষ কোথা বা হয় শেষ আবার তোমার সভা থেকে আসে যে আদেশ। নূতন গানে নূতন রাগে নূতন করে হৃদয় জাগে, সুরের পথে কোথা যে যাই না পাই সে উদ্দেশ। সন্ধ্যাবেলার সোনার আভায় মিলিয়ে নিয়ে তান পূরবীতে শেষ করেছি যখন আমার গান-- নিশীথ রাতের গভীর সুরে আবার জীবন উঠে পুরে, তখন আমার নয়নে আর রয় না নিদ্রালেশ।
বয়স আমার হবে তিরিশ, দেখতে আমায় ছোটো, আমি নই, মা, তোমার শিরিশ, আমি হচ্ছি নোটো। আমি যে রোজ সকাল হলে যাই শহরের দিকে চলে তমিজ মিঞার গোরুর গাড়ি চড়ে। সকাল থেকে সারা দুপর ইঁট সাজিয়ে ইঁটের উপর খেয়ালমতো দেয়াল তুলি গড়ে। ভাবছ তুমি নিয়ে ঢেলা ঘর-গড়া সে আমার খেলা, কক্খনো না সত্যিকার সে কোঠা। ছোটো বাড়ি নয় তো মোটে, তিনতলা পর্যন্ত ওঠে, থামগুলো তার এমনি মোটা মোটা। কিন্তু যদি শুধাও আমায় ঐখানেতেই কেন থামায়? দোষ কী ছিল ষাট-সত্তর তলা? ইঁট সুরকি জুড়ে জুড়ে একেবারে আকাশ ফুঁড়ে হয় না কেন কেবল গেঁথে চলা? গাঁথতে গাঁথতে কোথায় শেষে ছাত কেন না তারায় মেশে? আমিও তাই ভাবি নিজে নিজে। কোথাও গিয়ে কেন থামি যখন শুধাও, তখন আমি জানি নে তো তার উত্তর কী যে। যখন খুশি ছাতের মাথায় উঠছি ভারা বেয়ে। সত্যি কথা বলি, তাতে মজা খেলার চেয়ে। সমস্ত দিন ছাত-পিটুনী গান গেয়ে ছাত পিটোয় শুনি, অনেক নিচে চলছে গাড়িঘোড়া। বাসনওআলা থালা বাজায়; সুর করে ঐ হাঁক দিয়ে যায় আতাওআলা নিয়ে ফলের ঝোড়া। সাড়ে চারটে বেজে ওঠে, ছেলেরা সব বাসায় ছোটে হো হো করে উড়িয়ে দিয়ে ধুলো। রোদ্দুর যেই আসে পড়ে পুবের মুখে কোথায় ওড়ে দলে দলে ডাক দিয়ে কাকগুলো। আমি তখন দিনের শেষে ভারার থেকে নেমে এসে আবার ফিরে আসি আপন গাঁয়ে। জান তো, মা, আমার পাড়া যেখানে ওই খুঁটি গাড়া পুকুরপাড়ে গাজনতলার বাঁয়ে। তোরা যদি শুধাস মোরে খড়ের চালায় রই কী করে? কোঠা যখন গড়তে পারি নিজে; আমার ঘর যে কেন তবে সব-চেয়ে না বড়ো হবে? জানি নে তো তার উত্তর কী যে!
অনেক হাজার বছরের মরু-যবনিকার আচ্ছাদন যখন উৎক্ষিপ্ত হল, দেখা দিল তারিখ-হারানো লোকালয়ের বিরাট কঙ্কাল;-- ইতিহাসের অলক্ষ্য অন্তরালে ছিল তার জীবনক্ষেত্র। তার মুখরিত শতাব্দী আপনার সমস্ত কবিগান বাণীহীন অতলে দিয়েছে বিসর্জন। আর, যে-সব গান তখনো ছিল অঙ্কুরে, ছিল মুকুলে, যে বিপুল সম্ভাব্য সেদিন অনালোকে ছিল প্রচ্ছন্ন অপ্রকাশ থেকে অপ্রকাশেই গেল মগ্ন হয়ে-- যা ছিল অপ্রজ্বল ধোঁওয়ার গোপন আচ্ছাদনে তাও নিবল। যা বিকাল, আর যা বিকাল না,-- দুই-ই সংসারের হাট থেকে গেল চলে একই মূল্যের ছাপ নিয়ে। কোথাও রইল না তার ক্ষত, কোথাও বাজল না তার ক্ষতি। ঐ নির্মল নিঃশব্দ আকাশে অসংখ্য কল্প-কল্পান্তরের হয়েছে আবর্তন। নূতন নূতন বিশ্ব অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে জন্ম নিয়েছে আলোকে, ভেসে চলেছে আলোড়িত নক্ষত্রের ফেনপুঞ্জে; অবশেষে যুগান্তে তারা তেমনি করেই গেছে যেমন গেছে বর্ষণশান্ত মেঘ, যেমন গেছে ক্ষণজীবী পতঙ্গ। মহাকাল, সন্ন্যাসী তুমি। তোমার অতলস্পর্শ ধ্যানের তরঙ্গ-শিখরে উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে সৃষ্টি আবার নেমে যাচ্ছে ধ্যানের তরঙ্গতলে। প্রচণ্ড বেগে চলেছে ব্যক্ত অব্যক্তের চক্রনৃত্য, তারি নিস্তব্ধ কেন্দ্রস্থলে তুমি আছ অবিচলিত আনন্দে। হে নির্মম, দাও আমাকে তোমার ঐ সন্ন্যাসের দীক্ষা। জীবন আর মৃত্যু, পাওয়া আর হারানোর মাঝখানে যেখানে আছে অক্ষুব্ধ শান্তি সেই সৃষ্টি-হোমাগ্নিশিখার অন্তরতম স্তিমিত নিভৃতে দাও আমাকে আশ্রয়।