একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে, বসন্তের নূতন হাওয়ার বেগে। তোমরা শুধায়েছিলে মোরে ডাকি পরিচয় কোনো আছে নাকি, যাবে কোন্খানে। আমি শুধু বলেছি, কে জানে। নদীতে লাগিল দোলা, বাঁধনে পড়িল টান, একা বসে গাহিলাম যৌবনের বেদনার গান। সেই গান শুনি কুসুমিত তরুতলে তরুণতরুণী তুলিল অশোক, মোর হাতে দিয়ে তারা কহিল, "এ আমাদেরই লোক।' আর কিছু নয়, সে মোর প্রথম পরিচয়।
তার পরে জোয়ারের বেলা সাঙ্গ হল, সাঙ্গ হল তরঙ্গের খেলা; কোকিলের ক্লান্ত গানে বিস্মৃত দিনের কথা অকস্মাৎ যেন মনে আনে; কনকচাঁপার দল পড়ে ঝুরে, ভেসে যায় দূরে-- ফাল্গুনের উৎসবরাতির নিমন্ত্রণলিখন-পাঁতির ছিন্ন অংশ তারা অর্থহারা। ভাঁটার গভীর টানে তরীখানা ভেসে যায় সমুদ্রের পানে। নূতন কালের নব যাত্রী ছেলেমেয়ে শুধাইছে দূর হতে চেয়ে, "সন্ধ্যার তারার দিকে বহিয়া চলেছে তরণী কে।' সেতারেতে বাঁধিলাম তার, গাহিলাম আরবার-- মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়।
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু স্টীমার । খুলনা বসে বসে লিখলেম চিঠি পুরিয়ে দিলাম চারটি পিঠই, পেলেম না তার জবাবই এমনি তোমার নবাবী! দুটো ছত্র লিখবি পত্র একলা তোমার "রব্-কা' যে! পোড়ারমুখী তাও হবে না আলিস্যি তোর সব কাজে! ঝগড়াটে নয় স্বভাব আমার নইলে দেখতে কারখানা, গলার চোটে আকাশ ফেটে হয়ে যেত চারখানা, বাছা আমার দেখতে পেতে এই কলমের ধারখানা! তোমার মতো এমনি মা তো দেখি নি এ বঙ্গে গো, মায়া দয়া যা-কিছু সে যদিন থাকে সঙ্গে গো! চোখের আড়াল প্রাণের আড়াল কেমনতরো ঢঙ এ গো! তোমার প্রাণ যে পাষাণ-সম জানি সেটা রষশফ তফষ! সংসারে যে সবি মায়া সেটা নেহাত গল্প না! বাইরেতে এক ভিতরে এক এ যেন কার খল-পনা! সত্যি বলে যেটা দেখি সেটা আমার কল্পনা! ভেবে একবার দেখো বাছা ফিলজফি অল্প না! মস্ত একটা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কে রেখেছে সাজিয়ে যা করি তা কেবল "থোড়া জমির বাস্তে কাজিয়ে!' বৃষ্টি পড়ে চিঠি না পাই, মনটা নিয়ে ততই হাঁপাই, শূন্যে চেয়ে ততই ভাবি সকলি ভোজ-বাজি এ! ফিলজফি মনের মধ্যে ততই ওঠে গাঁজিয়ে! দূর হোক গে, এত কথা কেনই বলি তোমাকে! ভরা নায়ে পা দিয়েছ, আছ তুমি দেমাকে! ... তোমার সঙ্গে আর কথা না, তুমি এখন লোকটা মস্ত, কাজ কি বাপু, এইখেনেতেই রবীন্দ্রনাথ হলেন অস্ত।