ভালোবাসার মূল্য আমায় দু হাত ভরে যতই দেবে বেশি করে, ততই আমার অন্তরের এই গভীর ফাঁকি আপনি ধরা পড়বে না কি। তাহার চেয়ে ঋণের রাশি রিক্ত করি যাই-না নিয়ে শূন্য তরী। বরং রব ক্ষুধার কাতর ভালো সেও, সুধার ভরা হৃদয় তোমার ফিরিয়ে নিয়ে চলে যেয়ো। পাছে আমার আপন ব্যথা মিটাইতে ব্যথা জাগাই তোমার চিতে, পাছে আমার আপন বোঝা লাঘব-তরে চাপাই বোঝা তোমার 'পরে, পাছে আমার একলা প্রাণের ক্ষুব্ধ ডাকে রাত্রে তোমায় জাগিয়ে রাখে, সেই ভয়েতেই মনের কথা কই নে খুলে। ভুলতে যদি পারো তবে সেই ভালো গো, যেয়ো ভুলে। বিজন পথে চলেছিলেম, তুমি এলে মুখে আমার নয়ন মেলে। ভেবেছিলেম বলি তোমায়, "সঙ্গে চলো, আমায় কিছু কথা বলো।' হঠাৎ তোমার মুখে চেয়ে কী কারণে ভয় হল যে আমার মনে। দেখেছিলেম সুপ্ত আগুন লুকিয়ে জ্বলে তোমার প্রাণের নিশীথ রাতের অন্ধকারের গভীর তলে। তপস্বিনী, তোমার তপের শিখাগুলি হঠাৎ যদি জাগিয়ে তুলি, তবে যে সেই দীপ্ত আলোয় আড়াল টুটে দৈন্য আমার উঠিবে ফুটে। হবি হবে তোমার প্রেমের হোমাগ্নিতে এমন কী মোর আছে দিতে। তাই তো আমি বলি তোমায় নতশিরে-- তোমার দেখার স্মৃতি নিয়ে একলা আমি যাব ফিরে।
ঐ যে রাতের তারা জানিস কি, মা, কারা? সারাটিখন ঘুম না জানে চেয়ে থাকে মাটির পানে যেন কেমনধারা! আমার যেমন নেইকো ডানা, আকাশপানে উড়তে মানা, মনটা কেমন করে, তেমনি ওদের পা নেই বলে পারে না যে আসতে চলে এই পৃথিবীর 'পরে। সকালে যে নদীর বাঁকে জল নিতে যাস কলসী কাঁখে শজনেতলার ঘাটে সেথায় ওদের আকাশ থেকে আপন ছায়া দেখে দেখে সারা পহর কাটে। ভাবে ওরা চেয়ে চেয়ে, হতেম যদি গাঁয়ের মেয়ে তবে সকালসাঁজে কলসীখানি ধরে বুকে সাঁতরে নিতেম মনের সুখে ভরা নদীর মাঝে। আর আমাদের ছাতের কোণে তাকায়, যেথা গভীর বনে রাক্ষসদের ঘরে রাজকন্যা ঘুমিয়ে থাকে, সোনার কাঠি ছুঁইয়ে তাকে জাগাই শয্যা 'পরে। ভাবে ওরা, আকাশ ফেলে হত যদি তোমার ছেলে, এইখানে এই ছাতে দিন কাটাত খেলায় খেলায় তার পরে সেই রাতের বেলায় ঘুমোত তোর সাথে। যেদিন আমি নিষুত রাতে হঠাৎ উঠি বিছানাতে স্বপন থেকে জেগে' জানলা দিয়ে দেখি চেয়ে তারাগুলি আকাশ ছেয়ে ঝাপসা আছে মেঘে! বসে বসে ক্ষণে ক্ষণে সেদিন আমার হয় যে মনে ওদের স্বপ্ন বলে। অন্ধকারের ঘুম লাগে যেই ওরা আসে সেই পহরেই, ভোর বেলা যায় চলে। আঁধার রাতি অন্ধ ও যে, দেখতে না পায়, আলো খোঁজে, সবই হারিয়ে ফেলে। তাই আকাশে মাদুর পেতে সমস্তখন স্বপনেতে দেখা-দেখা খেলে।
যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই-- যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই। এই জ্যোতিঃসমুদ্র-মাঝে যে শতদল পদ্ম রাজে তারি মধু পান করেছি ধন্য আমি তাই-- যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই। বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে, অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে। পরশ যাঁরে যায় না করা সকল দেহে দিলেন ধরা। এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিন তাই-- যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।