হে অশেষ, তব হাতে শেষ ধরে কী অপূর্ব বেশ, কী মহিমা। জ্যোতির্হীন সীমা মৃত্যুর অগ্নিতে জ্বলি যায় গলি, গড়ে তোলে অসীমের অলংকার। হয় সে অমৃতপাত্র, সীমার ফুরালে অহংকার। শেষের দীপালিরাত্রে,হে অশেষ, অমা-অন্ধকার-রন্ধ্রে দেখা যায় তোমার উদ্দেশ। ভোরের বাতাসে শেফালি ঝরিয়া পড়ে ঘাসে, তারাহারা রাত্রির বীণার চরম ঝংকার। যামিনীর তন্দ্রাহীন দীর্ঘ পথ ঘুরি প্রভাত-আকাশে চন্দ্র, করুণ মাধুরী শেষ করে যায় তার উদয়সূর্যের পানে শান্ত নমস্কার। যখন কর্মের দিন ম্লান ক্ষীণ গোষ্ঠ-চলা ধেনুসম সন্ধ্যার সমীরে চলে ধীরে আঁধারের তীরে -- তখন সোনার পাত্র হতে কী অজস্র স্রোতে তাহারে করাও স্নান অন্তিমের সৌন্দর্যধারায়। যখন বর্ষার মেঘ নিঃশেষে হারায় বর্ষণের সকল সম্বল, শরতে শিশুর জন্ম দাও তারে শুভ্র সমুজ্জল। হে অশেষ, তোমার অঙ্গনে ভারমুক্ত তার সাথে ক্ষণে ক্ষণে খেলায় রঙের খেলা, ভাসায়ে আলোর ভেলা, বিচিত্র করিয়া তোল তার শেষ বেলা। ক্লান্ত আমি তারি লাগি, অন্তর তৃষিত -- কত দূরে আছে সেই খেলাভরা মুক্তির অমৃত। বধূ যথা গোধূলিতে শেষ ঘট ভরে বেণুচ্ছায়াঘন পথে অন্ধকারে ফিরে যায় ঘরে, সেই মতো, হে সুন্দর, মোর অবসান তোমার মাধুরী হতে সুধাস্রোতে ভরে নিতে চায় তার দিনান্তের গান। হে ভীষণ, তব স্পর্শঘাত অকস্মাৎ মোর গূঢ় চিত্ত হতে কবে চরম বেদনা-উৎস মুক্ত করি অগ্নিমহোৎসবে অপূর্ণের যত দুঃখ যত অসম্মান উচ্ছ্বসিত রুদ্র হাস্যে করি দিবে শেষ দীপ্যমান।
দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ওই ছায়া ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ। ও পারেতে সোনার কূলে আঁধারমূলে কোন্ মায়া গেয়ে গেল কাজ-ভাঙানো গান। নামিয়ে মুখ চুকিয়ে সুখ যাবার মুখে যায় যারা ফেরার পথে ফিরেও নাহি চায়, তাদের পানে ভাঁটার টানে যাব রে আজ ঘরছাড়া-- সন্ধ্যা আসে দিন যে চলে যায়। ওরে আয় আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়। সাঁজের বেলা ভাঁটার স্রোতে ও পার হতে একটানা একটি-দুটি যায় যে তরী ভেসে। কেমন করে চিনব ওরে ওদের মাঝে কোন্খানা আমার ঘাটে ছিল আমার দেশে। অস্তাচলে তীরের তলে ঘন গাছের কোল ঘেঁষে ছায়ায় যেন ছায়ার মতো যায়, ডাকলে আমি ক্ষণেক থামি হেথায় পাড়ি ধরবে সে এমন নেয়ে আছে রে কোন্ নায়। ওরে আয় আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়। ঘরেই যারা যাবার তারা কখন গেছে ঘরপানে, পারে যারা যাবার গেছে পারে; ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে নেয় তারে। ফুলের বার নাইকো আর, ফসল যার ফলল না-- চোখের জল ফেলতে হাসি পায়-- দিনের আলো যার ফুরালো, সাঁজের আলো জ্বলল না, সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়। ওরে আয় আমায় নিয়ে যাবি কে রে বেলাশেষের শেষ খেয়ায়।
তোমার সাথে নিত্য বিরোধ আর সহে না-- দিনে দিনে উঠছে জমে কতই দেনা। সবাই তোমায় সভার বেশে প্রণাম করে গেল এসে, মলিন বাসে লুকিয়ে বেড়াই মান রহে না। কী জানাব চিত্তবেদন, বোবা হয়ে গেছে যে মন, তোমার কাছে কোনো কথাই আর কহে না। ফিরায়ো না এবার তারে লও গো অপমানের পারে, করো তোমার চরণতলে চির-কেনা।