কালো অন্ধকারের তলায় পাখির শেষ গান গিয়েছে ডুবে। বাতাস থমথমে, গাছের পাতা নড়ে না, স্বচ্ছরাত্রের তারাগুলি যেন নেমে আসছে পুরাতন মহানিম গাছের ঝিল্লি-ঝংকৃত স্তব্ধ রহস্যের কাছাকাছি। এমন সময়ে হঠাৎ আবেগে আমার হাত ধরলে চেপে; বললে, "তোমাকে ভুলব না কোনোদিনই।" দীপহীন বাতায়নে আমার মূর্তি ছিল অস্পষ্ট, সেই ছায়ার আবরণে তোমার অন্তরতম আবেদনের সংকোচ গিয়েছিল কেটে। সেই মুহূর্তে তোমার প্রেমের অমরাবতী ব্যাপ্ত হল অনন্ত স্মৃতির ভূমিকায়। সেই মুহূর্তের আনন্দবেদনা বেজে উঠল কালের বীণায়, প্রসারিত হল আগামী জন্মজন্মান্তরে। সেই মুহূর্তে আমার আমি তোমার নিবিড় অনুভবের মধ্যে পেল নিঃসীমতা। তোমার কম্পিত কণ্ঠের বাণীটুকুতে সার্থক হয়েছে আমার প্রাণের সাধনা, সে পেয়েছে অমৃত। তোমার সংসারে অসংখ্য যা-কিছু আছে তার সবচেয়ে অত্যন্ত ক'রে আছি আমি, অত্যন্ত বেঁচে। এই নিমেষটুকুর বাইরে আর যা-কিছু সে গৌণ। এর বাইরে আছে মরণ, একদিন রূপের আলো-জ্বালা রঙ্গমঞ্চ থেকে সরে যাব নেপথ্যে। প্রত্যক্ষ সুখদুঃখের জগতে মূর্তিমান অসংখ্যতার কাছে আমার স্মরণচ্ছায়া মানবে পরাভব। তোমার দ্বারের কাছে আছে যে কৃষ্ণচূড়া যার তলায় দুবেলা জল দাও আপন হাতে, সেও প্রধান হয়ে উঠে' তার ডালপালার বাইরে সরিয়ে রাখবে আমাকে বিশ্বের বিরাট অগোচরে। তা হোক, এও গৌণ।
ছবি আঁকার মানুষ ওগো পথিক চিরকেলে, চলছ তুমি আশেপাশে দৃষ্টির জাল ফেলে। পথ-চলা সেই দেখাগুলো লাইন দিয়ে এঁকে পাঠিয়ে দিলে দেশ-বিদেশের থেকে। যাহা-তাহা যেমন-তেমন আছে কতই কী যে, তোমার চোখে ভেদ ঘটে নাই চণ্ডালে আর দ্বিজে। ঐ যে গরিবপাড়া, আর কিছু নেই ঘেঁষাঘেঁষি কয়টা কুটীর ছাড়া। তার ওপারে শুধু চৈত্রমাসের মাঠ করছে ধু ধু। এদের পানে চক্ষু মেলে কেউ কভু কি দাঁড়ায়, ইচ্ছে ক'রে এ ঘরগুলোর ছায়া কি কেউ মাড়ায়। তুমি বললে, দেখার ওরা অযোগ্য নয় মোটে; সেই কথাটিই তুলির রেখায় তক্ষনি যায় রটে। হঠাৎ তখন ঝেঁকে উঠে আমরা বলি, তাই তো, দেখার মতোই জিনিস বটে, সন্দেহ তার নাই তো। ঐযে কারা পথে চলে, কেউ করে বিশ্রাম, নেই বললেই হয় ওরা সব, পোঁছে না কেউ নাম-- তোমার কলম বললে, ওরা খুব আছে এই জেনো; অমনি বলি, তাই বটে তো, সবাই চেনো-চেনো। ওরাই আছে, নেইকো কেবল বাদশা কিংবা নবাব; এই ধরণীর মাটির কোলে থাকাই ওদের স্বভাব। অনেক খরচ ক'রে রাজা আপন ছবি আঁকায়, তার পানে কি রসিক লোকে কেউ কখনো তাকায়। সে-সব ছবি সাজে-সজ্জায় বোকার লাগায় ধাধাঁ, আর এরা সব সত্যি মানুষ সহজ রূপেই বাঁধা। ওগো চিত্রী, এবার তোমার কেমন খেয়াল এ যে, এঁকে বসলে ছাগল একটা উচ্চশ্রবা ত্যেজে। জন্তুটা তো পায় না খাতির হঠাৎ চোখে ঠেকলে, সবাই ওঠে হাঁ হাঁ ক'রে সবজি-খেতে দেখলে। আজ তুমি তার ছাগলামিটা ফোটালে যেই দেহে এক মুহূর্তে চমক লেগে বলে উঠলেম, কে হে। ওরে ছাগলওয়ালা, এটা তোরা ভাবিস কার-- আমি জানি, একজনের এই প্রথম আবিষ্কার।