এই মহাবিশ্বতলে যন্ত্রণার ঘূর্ণযন্ত্র চলে, চূর্ণ হতে থাকে গ্রহতারা। উৎক্ষিপ্ত স্ফুলিঙ্গ যত দিক্ বিদিকে অস্তিত্বের বেদনারে প্রলয়দুঃখের রেণুজালে ব্যাপ্ত করিবারে ছোটে প্রচণ্ড আবেগে। পীড়নের যন্ত্রশালে চেতনার উদ্দীপ্ত প্রাঙ্গণে কোথা শেল শূল যত হতেছে ঝংকৃত, কোথা ক্ষতরক্ত উৎসারিছে। মানুষের ক্ষুদ্র দেহ, যন্ত্রণার শক্তি তার কী দুঃসীম। সৃষ্টি ও প্রলয়-সভাতলে-- তার বহ্নিরসপাত্র কী লাগিয়া যোগ দিল বিশ্বের ভৈরবীচক্রে, বিধাতার প্রচণ্ড মত্ততা-- কেন এ দেহের মৃৎভাণ্ড ভরিয়া রক্তবর্ণ প্রলাপেরে অশ্রুস্রোতে করে বিপ্লাবিত। প্রতি ক্ষণে অন্তহীন মূল্য দিল তারে মানবের দুর্জয় চেতনা, দেহদুঃখ-হোমানলে যে অর্ঘ্যের দিল সে আহুতি-- জ্যোতিষ্কের তপস্যায় তার কি তুলনা কোথা আছে। এমন অপরাজিত বীর্যের সম্পদ, এমন নির্ভীক সহিষ্ণুতা, এমন উপেক্ষা মরণেরে, হেন জয়যাত্রা বহ্নিশয্যা মাড়াইয়া দলে দলে দুঃখের সীমান্ত খুঁজিবারে নামহীন জ্বালাময় কী তীর্থের লাগি-- সাথে সাথে পথে পথে এমন সেবার উৎস আগ্নেয় গহ্বর ভেদ করি অফুরান প্রেমের পাথেয়।
দূরে গিয়েছিলে চলি; বসন্তের আনন্দভাণ্ডার তখনো হয় নি নিঃস্ব; আমার বরণপুষ্পহার তখনো অম্লান ছিল ললাটে তোমার। হে অধীর, কোন্ অলিখিত লিপি দক্ষিণের উদ্ভ্রান্ত সমীর এনেছিল চিত্তে তব। তুমি গেলে বাঁশি লয়ে হাতে, ফিরে দেখ নাই চেয়ে আমি বসে আপন বীণাতে বাঁধিতেছিলাম সুর গুঞ্জরিয়া বসন্তপঞ্চমে, আমার অঙ্গনতলে আলো আর ছায়ার সংগমে কম্পমান আম্রতরু করেছিল চাঞ্চল্য বিস্তার সৌরভবিহ্বল শুক্লরাতে। সেই কুঞ্জগৃহদ্বার এতকাল মুক্ত ছিল। প্রতিদিন মোর দেহলিতে আঁকিয়াছি আলিপনা। প্রতিসন্ধ্যা বরণডালিতে গন্ধতৈলে জ্বালায়েছি দীপ। আজি কতকাল পরে যাত্রা তব হল অবসান। হেথা ফিরিবার তরে হেথা হতে গিয়েছিলে। হে পথিক, ছিল এ লিখন-- আমারে আড়াল করে আমারে করিবে অন্বেষণ; সুদূরের পথ দিয়ে নিকটেরে লাভ করিবারে আহ্বান লভিয়াছিলে সখা। আমার প্রাঙ্গণদ্বারে যে পথ করিলে শুরু সে পথের এখানেই শেষ। হে বন্ধু, কোরো না লজ্জা, মোর মনে নাই ক্ষোভলেশ, নাই অভিমানতাপ। করিব না ভর্ৎসনা তোমায়; গভীর বিচ্ছেদ আজি ভরিয়াছি অসীম ক্ষমায়। আমি আজি নবতর বধূ, আজি শুভদৃষ্টি তব বিরহগুণ্ঠনতলে দেখে যেন মোরে অভিনব অপূর্ব আনন্দরূপে, আজি যেন সকল সন্ধান প্রভাতে নক্ষত্রসম শুভ্রতায় লভে অবসান। আজি বাজিবে না বাঁশি, জ্বলিবে না প্রদীপের মালা, পরিব না রক্তাম্বর; আজিকার উৎসব নিরালা সর্ব-আভরণহীন। আকাশেতে প্রতিপদ-চাঁদ কৃষ্ণপক্ষ পার হয়ে পূর্ণতার প্রথম প্রসাদ লভিয়াছে। দিক্প্রান্তে তারি ওই ক্ষীণ নম্র কলা নীরবে বলুক আজি আমাদের সব কথা বলা।
মনে করো, তুমি থাকবে ঘরে, আমি যেন যাব দেশান্তরে। ঘাটে আমার বাঁধা আছে তরী, জিনিসপত্র নিয়েছি সব ভরি -- ভালো করে দেখ্ তো মনে করি কী এনে মা, দেব তোমার তরে। চাস কি মা, তুই এত এত সোনা -- সোনার দেশে করব আনাগোনা। সোনামতী নদীতীরের কাছে সোনার ফসল মাঠে ফ'লে আছে, সোনার চাঁপা ফোটে সেথায় গাছে -- না কুড়িয়ে আমি তো ফিরব না।
পরতে কি চাস মুক্তো গেঁথে হারে -- জাহাজ বেয়ে যাব সাগর-পারে। সেখানে মা, সকালবেলা হলে ফুলের 'পরে মুক্তোগুলি দোলে, টুপটুপিয়ে পড়ে ঘাসের কোলে -- যত পারি আনব ভারে ভারে। দাদার জন্যে আনব মেঘে-ওড়া পক্ষিরাজের বাচ্ছা দুটি ঘোড়া। বাবার জন্যে আনব আমি তুলি কনক-লতার চারা অনেকগুলি -- তোর তরে মা, দেব কৌটা খুলি সাত-রাজার-ধন মানিক একটি জোড়া।