ওগো বৈতরণী, তরল খড়্গের মতো ধারা তব, নাই তার ধ্বনি, নাই তার তরঙ্গভঙ্গিমা; নাই রূপ, নাই স্পর্শ, ছন্দে তার নাই কোনো সীমা; অমাবস্যা রজনীর সুপ্তি সুগম্ভীর মৌনী প্রহরের মতো নিরাকার পদচারে শূন্যে শূন্যে ধায় অবিরত। প্রাণের অরণ্যতট হতে দণ্ড পল খসে খসে পড়ে তব অন্ধকারস্রোতে। রূপের না থাকে চিহ্ন, নাহি থাকে বর্ণের বর্ণনা, বাণীর না থাকে এক কণা। ওগো বৈতরণী, কতবার খেয়ার তরণী এসেছিল এই ঘাটে আমার এ বিশ্বের আলোতে। নিয়ে গেল কালহীন তোমার কালোতে কত মোর উৎসবের বাতি, আমার প্রাণের আশা, আমার গানের কত সাথি, দিবসেরে রিক্ত করি, তিক্ত করি, আমার রাত্রিরে। সেই হতে চিত্ত মোর নিয়েছে আশ্রয় তব তীরে। ওগো বৈতরণী, অদৃশ্যের উপকূলে থেমে গেছে যেথায় ধরণী সেথায় নির্জনে দেখি আমি আপনার মনে তোমার অরূপতলে সব রূপ পূর্ণ হয়ে ফুটে, সব গান দীপ্ত হয়ে উঠে শ্রবণের পরপারে তব নিঃশব্দের কণ্ঠহারে। যে সুন্দর বসেছিল মোর পাশে এসে ক্ষণিকের ক্ষীণ ছদ্মবেশে, যে চিরমধুর দ্রুতপদে চলে গেল নিমেষের বাজায়ে নূপুর প্রলয়ের অন্তরালে গাহে তারা অনন্তের সুর। চোখের জলের মতো একটি বর্ষণে যারা হয়ে গেছে গত, চিত্তের নিশীথ রাত্রে গাঁথে তারা নক্ষত্রমালিকা-- অনির্বাণ আলোকেতে সাজায় অক্ষয় দীপালিকা।
জানি গো দিন যাবে। এ দিন যাবে। একদা কোন্ বেলাশেষে মলিন রবি করুণ হেসে শেষ বিদায়ের চাওয়া আমার মুখের পানে চাবে। পথের ধারে বাজবে বেণু, নাদীর কূলে চরবে ধেনু, আঙিনাতে খেলবে শিশু, পাখিরা গান গাবে। তবুও দিন যাবে এ দিন যাবে। তোমার কাছে আমার এ মিনতি। যাবার আগে জানি যেন আমায় ডেকেছিল কেন আকাশপানে নয়ন তুলে শ্যামল বসুমতী? কেন নিশার নীরবতা শুনিয়েছিল তারার কথা, পরানে ঢেউ তুলেছিল কেন দিনের জ্যোতি? তোমার কাছে আমার এই মিনতি। সাঙ্গ যবে হবে ধরার পালা যেন আমার গানের শেষে থামতে পারি সমে এসে, ছয়টি ঋতুর ফুলে ফুলে ভরতে পারি ডালা। এই জীবনের আলোকেতে পারি তোমায় দেখে যেতে, পরিয়ে যেতে পারি তোমায় আমার গলার মালা সাঙ্গ যবে হবে ধরার পালা।