পাখি বলে "আমি চলিলাম', ফুল বলে "আমি ফুটিব না', মলয় কহিয়া গেল শুধু "বনে বনে আমি ছুটিব না'। কিশলয় মাথাটি না তুলে মরিয়া পড়িয়া গেল ঝরি, সায়াহ্ন ধুমলঘন বাস টানি দিল মুখের উপরি। পাখি কেন গেল গো চলিয়া, কেন ফুল কেন সে ফুটে না। চপল মলয় সমীরণ বনে বনে কেন সে ছুটে না। শীতের হৃদয় গেছে চলে, অসাড় হয়েছে তার মন, ত্রিবলিবলিত তার ভাল কঠোর জ্ঞানের নিকেতন। জ্যোৎস্নার যৌবন-ভরা রূপ, ফুলের যৌবন পরিমল, মলয়ের বাল্যখেলা যত, পল্লবের বাল্য-কোলাহল-- সকলি সে মনে করে পাপ, মনে করে প্রকৃতির ভ্রম, ছবির মতন বসে থাকা সেই জানে জ্ঞানীর ধরম। তাই পাখি বলে "চলিলাম', ফুল বলে "আমি ফুটিব না'। মলয় কহিয়া গেল শুধু "বনে বনে আমি ছুটিব না'। আশা বলে "বসন্ত আসিবে', ফুল বলে "আমিও আসিব', পাখি বলে "আমিও গাহিব', চাঁদ বলে "আমিও হাসিব'। বসন্তের নবীন হৃদয় নূতন উঠেছে আঁখি মেলে-- যাহা দেখে তাই দেখে হাসে, যাহা পায় তাই নিয়ে খেলে। মনে তার শত আশা জাগে, কী যে চায় আপনি না বুঝে-- প্রাণ তার দশ দিকে ধায় প্রাণের মানুষ খুঁজে খুঁজে। ফুল ফুটে, তারো মুখ ফুটে-- পাখি গায়, সেও গান গায়-- বাতাস বুকের কাছে এলে গলা ধ'রে দুজনে খেলায়। তাই শুনি "বসন্ত আসিবে' ফুল বলে "আমিও আসিব', পাখি বলে "আমিও গাহিব', চাঁদ বলে "আমিও হাসিব'। শীত, তুমি হেথা কেন এলে। উত্তরে তোমার দেশ আছে-- পাখি সেথা নাহি গাহে গান, ফুল সেথা নাহি ফুটে গাছে। সকলি তুষারমরুময়, সকলিআঁধার জনহীন-- সেথায় একেলা বসি বসি জ্ঞানী গো, কাটায়ো তব দিন।
আজ হল রবিবার, খুব মোটা বহরের কগজের এডিশন; যত আছে শহরের কানাকানি, যত আছে আজগবি সংবাদ, যায় নিকো কোনোটার একটুও রঙ বাদ। "বার্তাকু' লিখে দিল, গুজরানওয়ালায় দলে দলে জোট করে পাঞ্জাবি গোয়ালায়। বলে তারা, গোরু পোষা গ্রাম্য এ কারবার প্রগতির যুগ আজ দিন এল ছাড়বার। আজ থেকে প্রত্যহ রাত্তির পোয়ালেই বসবে প্রেপরিটরি ক্লাস এই গোয়ালেই। স্তূপ রচা দুই বেলা খড়-ভুষি-ঘাসটার ছেড়ে দিয়ে হবে ওরা ইস্কুলমাস্টার। হম্বাধ্বনি যাহা গো-শিশু গো-বৃদ্ধের অন্তর্ভূত হবে বই-গেলা বিদ্যের। যত অভ্যেস আছে লেজ ম'লে পিটোনো ছেলেদের পিঠে হবে পেট ভ'রে মিটোনো। "গদাধরে' রেগে লেখে, এ কেমন ঠাট্টা-- বার্তাকু পরে পরে সাতটা কি আটটা যা লিখেছে সব কটা সমাজের বিরোধী, মতগুলো প্রগতির দ্বার আছে নিরোধি। সেদিন সে লিখেছিল, ঘুঁটে চাই চালানো, শহরের ঘরে ঘরে ঘুঁটে হোক জ্বালানো। কয়লা ঘুঁটেতে যেন সাপে আর নেউলে, ঝড়িয়াকে করে দিক একদম দেউলে। সেনেট হাউস আদি বড়ো বড়ো দেয়ালী শহরের বুক জুরে আছে যেন হেঁয়ালি। ঘুঁটে দিয়ে ভরা হোক, এই এক ফতোয়ায় এক দিনে শহরের বেড়ে যাবে কত আয়। গোয়ালারা চোনা যদি জমা করে গামলায় কত টাকা বাঁচে তবে জল-দেওয়া মামলায়। বার্তাকু কাগজের ব্যঙ্গে যে গা জ্বলে, সুন্দর মুখ পেলে লেপে ওরা কাজলে। এ-সকল বিদ্রূপে বুদ্ধি যে খেলো হয়, এ দেশের আবহাওয়া ভারি এলোমেলো হয়। গদাধর কাগজের ধমকানি থামল, হেসে উঠে বার্তাকু যুদ্ধেতে নামল। বলে, ভায়া, এ জগতে ঠাট্টা সে ঠাট্টাই-- গদাধর, গদা রেখে লও সেই পাঠটাই। মাস্টার না হয়ে যে হলে তুমি এডিটর এ লাগি তোমার কাছে দেশটাই ক্রেডিটর। এডুকেশনের পথে হয় নি যে মতি তব, এই পুণ্যেই হবে গোকুলেই গতি তব। অবশেষে এ দুখানা কাগজের আসরে বচসার ঝাঁজ দেখে ভয়ে কথা না সরে।
সন্ধেবেলায় বন্ধুঘরে জুটল চুপিচুপি গোপেন্দ্র মুস্তুফি। রাত্রে যখন ফিরল ঘরে সবাই দেখে তারিফ করে-- পাগড়িতে তার জুতোজোড়া, পায়ে রঙিন টুপি। এই উপদেশ দিতে এল-- সব করা চাই এলোমেলো, 'মাথায় পায়ে রাখব না ভেদ' চেঁচিয়ে বলে গুপি।