যে গান গাহিয়াছিনু কবেকার দক্ষিণ বাতাসে সে গান আমার কাছে কেন আজ ফিরে ফিরে আসে শরতের অবসানে। সেদিনের সাহানার সুর আজি অসময়ে এসে অকারণে করিছে বিধুর মধ্যাহ্নের আকাশেরে; দিগন্তের অরণ্যরেখায় দূর অতীতের বাণী লিপ্ত আছে অস্পষ্ট লেখায়, তাহারে ফুটাতে চাহে। পথভ্রান্ত করুণ গুঞ্জনে মধু আহরিতে ফিরে, সেদিনের অকৃপণ বনে যে চামেলিবল্লী ছিল তারি শূন্য দানসত্র হতে। ছায়াতে যা লীন হল তারে খোঁজে নিষ্ঠুর আলোতে। শীতরিক্ত শাখা ছেড়ে পাখি গেছে সিন্ধুপারে চলি, তারি কুলায়ের কাছে সে কালের বিস্মৃত কাকলি বৃথাই জাগাতে আসে। যে তারকা অস্তে গেল দূরে তাহারি স্পন্দন ও-যে ধরিয়া এনেছে নিজ সুরে।
অপরাধ যদি ক'রে থাকো কেন ঢাকো মিথ্যা মোর কাছে। শাসনের দণ্ড সে কি এই হাতে আছে যে হাতে তোমার কণ্ঠে পরায়েছি বরণের হার। শাস্তি এ আমার। ভাগ্যেরে করেছি জয় এ বিশ্বাসে মনে মনে ছিলাম নির্ভয়। আলস্যে কি ভেবেছিনু তাই-- সাধনার আয়োজনে আর মোর প্রয়োজন নাই। রুষ্ট ভাগ্য ভেঙে দিল অহংকার। যা ঘটিল তাই আমি করিনু স্বীকার। ক্ষমা করো মোরে। আপনারে রেখেছিনু কারাগার ক'রে তোমারে ঘিরিয়া, পীড়িয়াছি ফিরিয়া ফিরিয়া দিনে রাতে। কখনো অজ্ঞাতে যেখানে বেদনা তব সেখানে দিয়েছি মোর ভার। বিষম দুঃসহ বোঝা এ ভালোবাসার সেখানে দিয়েছি চেপে ভালোবাসা নেই যেখানেতে। বসেছি আসন পেতে যেখানে স্থানের টানাটানি। হায় জানি, কী ব্যথা কঠোর! এ প্রেমের কারাগারে মোর যন্ত্রণায় জাগি সুরঙ্গ কেটেছ যদি পরিত্রাণ লাগি দোষ দিব কারে। শাস্তি তো পেয়েছ তুমি এতদিন সেই রুদ্ধদ্বারে। সে শাস্তির হোক অবসান। আজ হতে মোর শাস্তি শুরু হবে, বিধির বিধান।
প্রদীপ যখন নিবেছিল, আঁধার যখন রাতি, দুয়ার যখন বন্ধ ছিল, ছিল না কেউ সাথি-- মনে হল অন্ধকারে কে এসেছে বাহির-দ্বারে, মনে হল শুনি যেন পায়ের ধ্বনি কার, রাতের হাওয়ায় বাজল বুঝি কঙ্কণঝংকার। বারেক শুধু মনে হল খুলি, দুয়ার খুলি। ক্ষণেক পরে ঘুমের ঘোরে কখন গেনু ভুলি। "কোন্ অতিথি দ্বারের কাছে একলা রাতে বসে আছে?' ক্ষণে ক্ষণে তন্দ্রা ভেঙে মন শুধাল যবে বলেছিলেম, "আর কিছু নয়, স্বপ্ন আমার হবে।' মাঝ-গগনে সপ্ত-ঋষি স্তব্ধ গভীর রাতে জানলা হতে আমায় যেন ডাকল ইশারাতে। মনে হল "শয়ন ফেলে, দিই-না কেন আলো জ্বেলে'-- আলসভরে রইনু শুয়ে হল না দীপ জ্বালা। প্রহর পরে কাটল প্রহর, বন্ধ রইল তালা। জাগল কখন দখিন-হাওয়া কাঁপল বনের হিয়া, স্বপ্নে কথা-কওয়ার মতো উঠল মর্মরিয়া। যুথীর গন্ধ ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছিল মোর বাতায়নে, শিহর দিয়ে গেল আমার সকল অঙ্গ চুমে। জেগে উঠে আবার কখন ভরল নয়ন ঘুমে। ভোরের তারা পুব-গগনে যখন হল গত বিদায়রাতির একটি ফোঁটা চোখের জলের মতো, হঠাৎ মনে হল তবে-- যেন কাহার করুণ রবে শিরীষ ফুলের গন্ধে আকুল বনের বীথি ব্যেপে শিশির-ভেজা তৃণগুলি উঠল কেঁপে কেঁপে। শয়ন ছেড়ে উঠে তখন খুলে দিলেম দ্বার-- হায় রে, ধুলায় বিছিয়ে গেছে যূথীর মালা কার। ওই যে দূরে, নয়ন নত, বনের ছায়ায় ছায়ার মতো মায়ার মতো মিলিয়ে গেল অরুণ-আলোয় মিশে, ওই বুঝি মোর বাহির-দ্বারের রাতের অতিথি সে। আজ হতে মোর ঘরের দুয়ার রাখব খুলে রাতে। প্রদীপখানি রইবে জ্বালা বাহির-জানালাতে। আজ হতে কার পরশ লাগি পথ তাকিয়ে রইব জাগি-- আর কোনোদিন আসবে না কি আমার পরান ছেয়ে যূথীর মালার গন্ধখানি রাতের বাতাস বেয়ে।