দেহে মনে সুপ্তি যবে করে ভর সহসা চৈতন্যলোকে আনে কল্পান্তর, জাগ্রত জগৎ চলে যায় মিথ্যার কোঠায়। তখন নিদ্রার শূন্য ভরি স্বপ্নসৃষ্টি শুরু হয়, ধ্রুব সত্য তারে মনে করি। সেও ভেঙে যায় যবে পুনর্বার জেগে উঠি অন্য এক ভবে; তখনি তাহারে সত্য বলি, নিশ্চিত স্বপ্নের রূপ অনিশ্চিতে কোথা যায় চলি। তাই ভাবি মনে যদি এ জীবন মোর গাঁথা থাকে মায়ার স্বপনে, মৃত্যুর আঘাতে জেগে উঠে অজিকার এ জগৎ অকস্মাৎ যায় টুটে, সব-কিছু অন্য-এক অর্থে দেখি-- চিত্ত মোর চমকিয়া সত্য বলি তারে জানিবে কি? সহসা কি উদিবে স্মরণে ইহাই জাগ্রত সত্য অন্যকালে ছিল তার মনে?
হে পথিক, তুমি একা। আপনার মনে জানি না কেমনে অদেখার পেলে দেখা। যে-পথে পড়ে নি পায়ের চিহ্ন সে পথে চলিলে রাতে, আকাশে দেখেছ কোন্ সংকেত, কারেও নিলে না সাথে। তুঙ্গগিরির উঠিছ শিখরে যেখানে ভোরের তারা অসীম আলোকে করিছে আপন আলোর যাত্রা সারা। প্রথম যেদিন ফাল্গুনতাপে নবনির্ঝর জাগে, মহাসুদূরের অপরূপ রূপ দেখিতে সে পায় আগে। আছে আছে আছে, এই বাণী তার এক নিমেষেই ফুটে, অচেনা পথের আহ্বান শুনে অজানার পানে ছুটে। সেইমতো এক অকথিত ভাষা ধ্বনিল তোমার মাঝে, আছে আছে আছে, এ মহামন্ত্র প্রতি নিশ্বাসে বাজে। রোধিয়াছে পথ বন্ধুর করি অচল শিলার স্তূপ। নহে নহে নহে, এ নিষেধবাণী পাষাণে ধরেছে রূপ। জড়ের সে নীতি করে গর্জন ভীরুজন মরে দুলে, জনহীন পথে সংশয়মোহ রহে তর্জনী তুলে। অলস মনের আপনারি ছায়া শঙ্কিল কায়া ধরে, অতি নিরাপদ বিনাশের তলে বাঁচিতে চেয়ে সে মরে। নবজীবনের সংকটপথে হে তুমি অগ্রগামী, তোমার যাত্রা সীমা মানিবে না কোথাও যাবে না থামি। শিখরে শিখরে কেতন তোমার রেখে যাবে নব নব, দুর্গম-মাঝে পথ করি দিবে,-- জীবনের ব্রত তব। যত আগে যাবে দ্বিধা সন্দেহ ঘুচে যাবে পাছে পাছে, পায়ে পায়ে তব ধ্বনিয়া উঠিবে মহাবাণী -- "আছে আছে।'
যখন আমায় বাঁধ আগে পিছে, মনে করি আর পাব না ছাড়া। যখন আমায় ফেল তুমি নীচে, মনে করি আর হব না খাড়া। আবার তুমি দাও যে বাঁধন খুলে, আবার তুমি নাও আমারে তুলে, চিরজীবন বাহু-দোলায় তব এমনি করে কেবলি দাও নাড়া। ভয় লাগায়ে তন্দ্রা কর ক্ষয়, ঘুম ভাঙায়ে তখন ভাঙ ভয়। দেখা দিয়ে ডাক দিয়ে যাও প্রাণে, তাহার পরে লুকাও যে কোন্খানে, মনে করি এই হারালেম বুঝি, কোথা হতে আবার যে দাও সাড়া।