অধিক করি না আশা, কিসের বিষাদ, জনমেছি দু দিনের তরে-- যাহা মনে আসে তাই আপনার মনে গান গাই আনন্দের ভরে। এ আমার গানগুলি দু দণ্ডের গান রবে না রবে না চিরদিন-- পুরব-আকাশ হতে উঠিবে উচ্ছ্বাস, পশ্চিমেতে হইবে বিলীন। তোরা-ফুল, তোরা পাখি, তোরা খোলা প্রাণ, জগতের আনন্দ যে তোরা, জগতের বিষাদ-পাসরা। পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দলহরী তোরা তার একেকটি ঢেউ, কখন উঠিলি আর কখন মিলালি জানিতেও পারিল না কেউ। নাই তোর নাই রে ভাবনা, এ জগতে কিছুই মরে না। নদীস্রোতে কোটি কোটি মৃত্তিকার কণা ভেসে আসে, সাগরে মিশায়-- জান না কোথায় তারা যায়! একেকটি কণা লয়ে গোপনে সাগর রচিছে বিশাল মহাদেশ, না জানি কবে তা হবে শেষ! মুহূর্তেই ভেসে যায় আমাদের গান, জান না তো কোথায় তা যায়! আকাশের সাগরসীমায়! আকাশ-সমুদ্র তলে গোপনে গোপনে গীতরাজ্য হতেছে সৃজন, যত গান উঠিতেছে ধরার আকাশে সেইখানে করিছে গমন। আকাশ পুরিয়া যাবে শেষ, উঠিবে গানের মহাদেশ। নাই তোর নাই রে ভাবনা এ জগতে কিছুই মরে না। কাল দেখেছিনু পথে হরষে খেলিতেছিল দুটি ভাই গলাগলি করি দেখেছিনু জানালায় নীরবে দাঁড়ায়েছিল দুটি সখা হাতে হাতে ধরি দেখেছিনু কচি মেয়ে মায়ের বাহুতে শুয়ে ঘুমায়ে করিছে স্তনপান, ঘুমন্ত মুখের 'পরে বরষিছে স্নেহধারা স্নেহমাখা নত দু'নয়ান দেখেছিনু রাজপথে চলেছে বালক এক বৃদ্ধ জনকের হাত ধরি-- কত কী যে দেখেছিনু, হয়তো সে-সব ছবি আজ আমি গিয়েছি পাসরি। তা বলে নাহি কি তাহা মনে? ছবিগুলি মেশেনি জীবনে? স্মৃতির কণিকা তারা স্মরণের তলে পশি রচিতেছে জীবন আমার-- কোথা যে কে মিশাইল, কেবা গেল কার পাশে চিনিতে পারি নে তাহা আর। হয়তো অনেকদিন দেখেছিনু ছবি এক দুটি প্রাণী বাহুর বাঁধনে তাই আজ ছুটাছুটি এসেছি প্রভাতে উঠি সখারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে। হয়তো অনেক দিন শুনেছিনু, পাখি এক আনন্দে গাহিছে প্রাণ খুলি, সহসা রে তাই আজ প্রভাতের মুখ দেখি প্রাণ মন উঠিছে উথুলি। সকলি মিশেছে আসি হেথা, জীবনে কিছু না যায় ফেলা এই যে যা-কিছু চেয়ে দেখি এ নহে কেবলি ছেলেখেলা। এই জগতের মাঝে একটি সাগর আছে নিস্তব্ধ তাহার জলরাশি, চারিদিক হতে সেথা অবিরাম অবিশ্রাম জীবনের স্রোত মিশে আসি। সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা, কোটি কোটি তারা হতে ঝরে, জগতের যত হাসি যত গান যত প্রাণ ভেসে আসে সেই স্রোতোভরে-- মেশে আসি সেই সিন্ধু-'পরে। পৃথ্বী হতে মহাস্রোত ছুটিতেছে অবিরাম সেই মহাসাগর-উদ্দেশে, আমরা মাটির কণা জলস্রোত ঘোলা করি অবিশ্রাম চলিয়াছি ভেসে-- সাগরে পড়িব অবশেষে। জগতের মাঝখানে সেই সাগরের তলে রচিত হতেছে পলে পলে অনন্ত-জীবন মহাদেশ, কে জানে হবে কি তাহা শেষ! তাই বলি, প্রাণ ওরে, গান গা পাখির মতো, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ শোক ভুলি-- তুই যাবি, গান যাবে, একসাথে ভেসে যাবে তুই আর তোর গানগুলি। মিশিবি সে সিন্ধুজলে অনন্তসাগরতলে, একসাথে শুয়ে রবি প্রাণ, তুই আর তোর এই গান।
কন্কনে ঠাণ্ডায় আমাদের যাত্রা-- ভ্রমণটা বিষম দীর্ঘ, সময়টা সব চেয়ে খারাপ, রাস্তা ঘোরালো, ধারালো বাতাসের চোট, একেবারে দুর্জয় শীত। ঘাড়ে ক্ষত, পায়ে ব্যথা, মেজাজ-চড়া উটগুলো শুয়ে শুয়ে পড়ে গলা বরফে। মাঝে মাঝে মন যায় বিগড়ে যখন মনে পড়ে পাহাড়তলিতে বসন্তমঞ্জিল, তার চাতাল, আর শর্বতের পেয়ালা হাতে রেশমি সাজে যুবতীর দল। এ দিকে উটওয়ালারা গাল পাড়ে, গন্গন্ করে রাগে, ছুটে পালায় মদ আর মেয়ের খোঁজে। মশাল যায় নিভে, মাথা রাখবার জায়গা জোটে না। নগরে যাই, সেখানে বৈরিতা; নগরীতে সন্দেহ। গ্রামগুলো নোংরা, তারা চড়া দাম হাঁকে। কঠিন মুশকিল। শেষে ঠাওরালেম চলব সারারাত, মাঝে মাঝে নেব ঝিমিয়ে আর কানে কানে কেউ বা গান গাবে-- এ সমস্তই পাগলামি। ভোরের দিকে এলেম, যেখানে মিঠে শীত সেই পাহাড়ের খদে; সেখানে বরফ-সীমার নীচেটা ভিজে-ভিজে, ঘন গাছ-গাছালির গন্ধ। নদী চলেছে ছুটে, জলযন্ত্রের চাকা আঁধারকে মারছে চাপড়। দিগন্তের গায়ে তিনটে গাছ দাঁড়িয়ে, বুড়ো সাদা ঘোড়াটা মাঠ বেয়ে দৌড় দিয়েছে। পৌঁছলেম শরাবখানায়, তার কপাটের মাথায় আঙুরলতা। দুজন মানুষ খোলা দরোজার কাছে পাশা খেলছে টাকার লোভে, পা দিয়ে ঠেলছে শূন্য মদের কুপো। কোনো খবরই মিলল না সেখানে, চললেম আরো আগে। যেতে যেতে সন্ধে হল; সময় পেরিয়ে যায় যায়, তখন খুঁজে পেলেম জায়গাটা-- বলা যেতে পারে ব্যাপারটা তৃপ্তিজনক। মনে পড়ে এ-সব ঘটেছে অনেক কাল আগে, আবার ঘটে যেন এই ইচ্ছে, কিন্তু লিখে রাখো-- এই লিখে রাখো-- এত দূরে যে আমাদের টেনে নিয়েছিল সে কি জন্মের সন্ধানে না মৃত্যুর। জন্ম একটা হয়েছিল বটে-- প্রমাণ পেয়েছি, সন্দেহ নেই। এর আগে তো জন্মও দেখেছি, মৃত্যুও-- মনে ভাবতেম তারা এক নয়। কিন্তু এই-যে জন্ম এ বড়ো কঠোর-- দারুণ এর যাতনা, মৃত্যুর মতো, আমাদের মৃত্যুর মতোই। এলেম ফিরে আপন আপন দেশে, এই আমাদের রাজত্বগুলোয় আর কিন্তু স্বস্তি নেই সেই পুরানো বিধিবিধানে যার মধ্যে আছে সব অনাত্মীয় আপন দেবদেবী আঁকড়ে ধ'রে। আর-একবার মরতে পারলে আমি বাঁচি।