পুজোর ছুটি আসে যখন বকসারেতে যাবার পথে-- দূরের দেশে যাচ্ছি ভেবে ঘুম হয় না কোনো মতে। সেখানে যেই নতুন বাসায় হপ্তা দুয়েক খেলায় কাটে দূর কি আবার পালিয়ে আসে আমাদেরি বাড়ির ঘাটে! দূরের সঙ্গে কাছের কেবল কেনই যে এই লুকোচুরি, দূর কেন যে করে এমন দিনরাত্তির ঘোরাঘুরি। আমরা যেমন ছুটি হলে ঘরবাড়ি সব ফেলে রেখে রেলে চড়ে পশ্চিমে যাই বেরিয়ে পড়ি দেশের থেকে, তেমনিতরো সকালবেলা ছুটিয়ে আলো আকাশেতে রাতের থেকে দিন যে বেরোয় দূরকে বুঝি খুঁজে পেতে? সে-ও তো যায় পশ্চিমেতেই, ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যে হলে, তখন থেকে রাতের মাঝেই দূর সে আবার গেছে চলে। সবাই যেন পলাতকা মন টেকে না কাছের বাসায়। দলে দলে পলে পলে কেবল চলে দূরের আশায়। পাতায় পাতায় পায়ের ধ্বনি, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডাকাডাকি, হাওয়ায় হাওয়ায় যাওয়ার বাঁশি কেবল বাজে থাকি থাকি। আমায় এরা যেতে বলে, যদি বা যাই, জানি তবে দূরকে খুঁজে খুঁজে শেষে মায়ের কাছেই ফিরতে হবে।
তুমি মোরে অর্পিয়াছ যত অধিকার ক্ষুণ্ন না করিয়া কভু কণামাত্র তার সম্পূর্ণ সঁপিয়া দিব তোমার চরণে অকুণ্ঠিত রাখি তারে বিপদে মরণে। জীবন সার্থক হবে তবে। চিরদিন জ্ঞান যেন থাকে মুক্ত শৃঙ্খলাবিহীন। ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয় পদানত পৃথিবীর কারো কাছে। শুভচেষ্টা যত কোনো বাধা নাহি মানে কোনো শক্তি হতে আত্মা যেন দিবারাত্রি অবারিত স্রোতে সকল উদ্যম লয়ে ধায় তোমা-পানে সর্ব বন্ধ টুটি। সদা লেখা থাকে প্রাণে "তুমি যা দিয়েছ মোরে অধিকারভার তাহা কেড়ে নিতে দিলে অমান্য তোমার।'
দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ওই ছায়া ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ। ও পারেতে সোনার কূলে আঁধারমূলে কোন্ মায়া গেয়ে গেল কাজ-ভাঙানো গান। নামিয়ে মুখ চুকিয়ে সুখ যাবার মুখে যায় যারা ফেরার পথে ফিরেও নাহি চায়, তাদের পানে ভাঁটার টানে যাব রে আজ ঘরছাড়া-- সন্ধ্যা আসে দিন যে চলে যায়। ওরে আয় আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়। সাঁজের বেলা ভাঁটার স্রোতে ও পার হতে একটানা একটি-দুটি যায় যে তরী ভেসে। কেমন করে চিনব ওরে ওদের মাঝে কোন্খানা আমার ঘাটে ছিল আমার দেশে। অস্তাচলে তীরের তলে ঘন গাছের কোল ঘেঁষে ছায়ায় যেন ছায়ার মতো যায়, ডাকলে আমি ক্ষণেক থামি হেথায় পাড়ি ধরবে সে এমন নেয়ে আছে রে কোন্ নায়। ওরে আয় আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়। ঘরেই যারা যাবার তারা কখন গেছে ঘরপানে, পারে যারা যাবার গেছে পারে; ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে নেয় তারে। ফুলের বার নাইকো আর, ফসল যার ফলল না-- চোখের জল ফেলতে হাসি পায়-- দিনের আলো যার ফুরালো, সাঁজের আলো জ্বলল না, সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়। ওরে আয় আমায় নিয়ে যাবি কে রে বেলাশেষের শেষ খেয়ায়।