করিয়াছি বাণীর সাধনা দীর্ঘকাল ধরি, আজ তারে ক্ষণে ক্ষণে উপহাস পরিহাস করি। বহু ব্যবহার আর দীর্ঘ পরিচয় তেজ তার করিতেছে ক্ষয়। নিজেরে করিয়া অবহেলা নিজেরে নিয়ে সে করে খেলা। তবু জানি, অজানার পরিচয় আছিল নিহিত বাক্যে তার বাক্যের অতীত। সেই অজানার দূত আজি মোরে নিয়ে যায় দূরে, অকূল সিন্ধুরে নিবেদন করিতে প্রণাম, মন তাই বলিতেছে, আমি চলিলাম। সেই সিন্ধু-মাঝে সূর্য দিনযাত্রা করি দেয় সারা, সেথা হতে সন্ধ্যাতারা রাত্রিরে দেখায়ে আনে পথ যেথা তার রথ চলেছে সন্ধান করিবারে নূতন প্রভাত-আলো তমিস্রার পারে। আজ সব কথা, মনে হয়, শুধু মুখরতা। তারা এসে থামিয়াছে পুরাতন সে মন্ত্রের কাছে ধ্বনিতেছে যাহা সেই নৈঃশব্দ্যচূড়ায় সকল সংশয় তর্ক যে মৌনের গভীরে ফুরায়। লোকখ্যাতি যাহার বাতাসে ক্ষীণ হয়ে তুচ্ছ হয়ে আসে। দিনশেষে কর্মশালা ভাষা রচনার নিরুদ্ধ করিয়া দিক দ্বার। পড়ে থাক্ পিছে বহু আবর্জনা, বহু মিছে। বারবার মনে মনে বলিতেছি, আমি চলিলাম-- যেথা নাই নাম, যেখানে পেয়েছে লয় সকল বিশেষ পরিচয়, নাই আর আছে এক হয়ে যেথা মিশিয়াছে, যেখানে অখন্ড দিন আলোহীন অন্ধকারহীন, আমার আমির ধারা মিলে যেথা যাবে ক্রমে ক্রমে পরিপূর্ণ চৈতন্যের সাগরসংগমে। এই বাহ্য আবরণ, জানি না তো, শেষে নানা রূপে রূপান্তরে কালস্রোতে বেড়াবে কি ভেসে। আপন স্বাতন্ত্র৻ হতে নিঃসক্ত দেখিব তারে আমি বাহিরে বহুর সাথে জড়িত অজানা তীর্থগামী। আসন্ন বর্ষের শেষ। পুরাতন আমার আপন শ্লথবৃন্ত ফলের মতন ছিন্ন হয়ে আসিতেছে। অনুভব তারি আপনারে দিতেছে বিস্তারি আমার সকল-কিছু-মাঝে প্রচ্ছন্ন বিরাজে নিগূঢ় অন্তরে যেই একা, চেয়ে আছি পাই যদি দেখা। পশ্চাতের কবি মুছিয়া করিছে ক্ষীণ আপন হাতের আঁকা ছবি। সুদূর সম্মুখে সিন্ধু, নিঃশব্দ রজনী, তারি তীর হতে আমি আপনারি শুনি পদধ্বনি। অসীম পথের পান্থ, এবার এসেছি ধরা-মাঝে মর্তজীবনের কাজে। সে পথের 'পরে ক্ষণে ক্ষণে অগোচরে সকল পাওয়ার মধ্যে পেয়েছি অমূল্য উপাদেয় এমন সম্পদ যাহা হবে মোর অক্ষয় পাথেয়। মন বলে, আমি চলিলাম, রেখে যাই আমার প্রণাম তাঁদের উদ্দেশে যাঁরা জীবনের আলো ফেলেছেন পথে যাহা বারে বারে সংশয় ঘুচালো।
আকাশে চেয়ে দেখি অবকাশের অন্ত নেই কোথাও। দেশকালের সেই সুবিপুল আনুকূল্যে তারায় তারায় নিঃশব্দ আলাপ, তাদের দ্রুতবিচ্ছুরিত আলোক-সংকেতে তপস্বিনী নীরবতার ধ্যান কম্পমান। অসংখ্যের ভারে পরিকীর্ণ আমার চিত্ত; চারদিকে আশু প্রয়োজনের কাঙালের দল; অসীমের অবকাশকে খণ্ড খণ্ড করে ভিড় করেছে তারা উৎকণ্ঠ কোলাহলে। সংকীর্ণ জীবনে আমার স্বর তাই বিজড়িত, সত্য পৌঁছয় না অনুজ্জ্বল বাণীতে। প্রতিদিনের অভ্যস্ত কথার মূল্য হল দীন; অর্থ গেল মুছে। আমার ভাষা যেন কুয়াশার জড়িমায় অবমানিত হেমন্তের বেলা, তার সুর পড়েছে চাপা। সুস্পষ্ট প্রভাতের মতো মন অনায়াসে মাথা তুলে বলতে পারে না-- "ভালোবাসি।" সংকোচ লাগে কণ্ঠের কৃপণতায়। তাই ওগো বনস্পতি, তোমার সম্মুখে এসে বসি সকালে বিকালে, শ্যামচ্ছায়ায় সহজ করে নিতে চাই আমার বাণী। দেখি চেয়ে, তোমার পল্লবস্তবক অনায়াসে পার হয়েছে শাখাব্যূহের জটিলতা, জয় করে নিয়েছে চারদিকে নিস্তব্ধ অবকাশ। তোমার নিঃশব্দ উচ্ছ্বাস সেই উদার পথে উত্তীর্ণ হয়ে যায় সূর্যোদয়-মহিমার মাঝে। সেই পথ দিয়ে দক্ষিণ বাতাসের স্রোতে অনাদি প্রাণের মন্ত্র তোমার নবকিশলয়ের মর্মে এসে মেলে-- বিশ্বহৃদয়ের সেই আনন্দমন্ত্র-- "ভালোবাসি।" বিপুল ঔৎসুক্য আমাকে বহন করে নিয়ে যায় সুদূরে; বর্তমান মুহূর্তগুলিকে অবলুপ্ত করে কালহীনতায়। যেন কোন্ লোকান্তরগত চক্ষু জন্মান্তর থেকে চেয়ে থাকে অমার মুখের দিকে,-- চেতনাকে নিষ্কারণ বেদনায় সকল সীমার পরপারে দেয় পাঠিয়ে। ঊর্ধ্বলোক থেকে কানে আসে সৃষ্টির শাশ্বতবাণী-- "ভালোবাসি।" যেদিন যুগান্তের রাত্রি হল অবসান আলোকের রশ্মিদূত বিকীর্ণ করেছিল এই আদিমবাণী আকাশে আকাশে। সৃষ্টিযুগের প্রথম লগ্নে প্রাণসমুদ্রের মহাপ্লাবনে তরঙ্গে তরঙ্গে দুলেছিল এই মন্ত্র-বচন। এই বাণীই দিনে দিনে রচনা করেছে স্বর্ণচ্ছটায় মানসী প্রতিমা আমার বিরহ-গগনে অস্তসাগরের নির্জন ধূসর উপকূলে। আজ দিনান্তের অন্ধকারে এজন্মের যত ভাবনা যত বেদনা নিবিড় চেতনায় সম্মিলিত হয়ে সন্ধ্যাবেলার একলা তারার মতো জীবনের শেষবাণীতে হোক উদ্ভাসিত-- "ভালোবাসি।"