আজ এ মনের কোন্ সীমানায় যুগান্তরের প্রিয়া। দূরে-উড়ে-যাওয়া মেঘের ছিদ্র দিয়া কখনো আসিছে রৌদ্র কখনো ছায়া, আমার জীবনে তুমি আজ শুধু মায়া; সহজে তোমায় তাই তো মিলাই সুরে, সহজেই ডাকি সহজেই রাখি দূরে। স্বপ্নরূপিণী তুমি আকুলিয়া আছ পথ-খোওয়া মোর প্রাণের স্বর্গভূমি। নাই কোনো ভার, নাই বেদনার তাপ, ধূলির ধরায় পড়ে না পায়ের ছাপ। তাই তো আমার ছন্দে সহসা তোমার চুলের ফুলের গন্ধে জাগে নির্জন রাতের দীর্ঘশ্বাস, জাগে প্রভাতের পেলব তারায় বিদায়ের স্মিত হাস। তাই পথে যেতে কাশের বনেতে মর্মর দেয় আনি পাশ-দিয়ে-চলা ধানী-রঙ-করা শাড়ির পরশখানি। যদি জীবনের বর্তমানের তীরে আস কভু তুমি ফিরে স্পষ্ট আলোয়, তবে জানি না তোমার মায়ার সঙ্গে কায়ার কি মিল হবে। বিরহস্বর্গলোকে সে-জাগরণের রূঢ় আলোয় চিনিব কি চোখে-চোখে। সন্ধ্যাবেলায় যে-দ্বারে দিয়েছ বিরহকরুণ নাড়া, মিলনের ঘায়ে সে-দ্বার খুলিলে কাহারো কি পাবে সাড়া।
আধবুড়ো হিন্দুস্থানি, রোগা লম্বা মানুষ-- পাকা গোঁফ, দাড়ি-কামানো মুখ শুকিয়ে-আসা ফলের মতো। ছিটের মের্জাই গায়ে, মালকোঁচা ধুতি, বাঁ কাঁধে ছাতি, ডান হাতে খাটো লাঠি, পায়ে নাগরা-- চলেছে শহরের দিকে। ভাদ্রমাসের সকালবেলা, পাতলা মেঘের ঝাপসা রোদ্দুর; কাল গিয়েছে কম্বল-চাপা হাঁপিয়ে-ওঠা রাত, আজ সকালে কুয়াশা-ভিজে হাওয়া দোমনা ক'রে বইছে আমলকীর কচি ডালে। পথিকটিকে দেখা গেল আমার বিশ্বের শেষরেখাতে যেখানে বস্তুহারা ছায়াছবির চলাচল। ওকে শুধু জানলুম একজন লোক। ওর নাম নেই, সংজ্ঞা নেই, বেদনা নেই, কিছুতে নেই কোনো দরকার-- কেবল হাটে-চলার পথে ভাদ্রমাসের সকালবেলায় একজন লোক। সেও আমায় গেছে দেখে তার জগতের পোড়ো জমির শেষ সীমানায়, যেখানকার নীল কুয়াশার মাঝে কারো সঙ্গে সম্বন্ধ নেই কারো, যেখানে আমি-- একজন লোক। তার ঘরে তার বাছুর আছে, ময়না আছে খাঁচায়; স্ত্রী আছে তার, জাঁতায় আটা ভাঙে, পিতলের মোটা কাঁকন হাতে; আছে তার ধোবা প্রতিবেশী, আছে মুদি দোকানদার দেনা আছে কাবুলিদের কাছে; কোনোখানেই নেই আমি-- একজন লোক।