তোমায় যখন সাজিয়ে দিলেম দেহ, করেছ সন্দেহ সত্য আমার দিই নি তাহার সাথে। তাই কেবলি বাজে আমার দিনে রাতে সেই সুতীব্র ব্যথা-- এমন দৈন্য, এমন কৃপণতা, যৌবন-ঐশ্বর্যে আমার এমন অসম্মান। সে লাঞ্ছনা নিয়ে আমি পাই নে কোথাও স্থান এই বসন্তে ফুলের নিমন্ত্রণে। ধেয়ান-মগ্ন ক্ষণে নৃত্যহারা শান্ত নদী সুপ্ত তটের অরণ্যচ্ছায়ায় অবসন্ন পল্লীচেতনায় মেশায় যখন স্বপ্নে-বলা মৃদু ভাষার ধারা-- প্রথম রাতের তারা অবাক চেয়ে থাকে, অন্ধকারের পারে যেন কানাকানির মানুষ পেল কাকে, হৃদয় তখন বিশ্বলোকের অনন্ত নিভৃতে দোসর নিয়ে চায় যে প্রবেশিতে-- কে দেয় দুয়ার রুধে, একলা ঘরের স্তব্ধ কোণে থাকি নয়ন মুদে। কী সংশয়ে কেন তুমি এলে কাঙাল বেশে। সময় হলে রাজার মতো এসে জানিয়ে কেন দাও নি আমায় প্রবল তোমার দাবি। ভেঙে যদি ফেলতে ঘরের চাবি ধুলার 'পরে মাথা আমার দিতেম লুটায়ে, গর্ব আমার অর্ঘ্য হত পায়ে। দুঃখের সংঘাতে আজি সুধার পাত্র উঠেছে এই ভ'রে, তোমার পানে উদ্দেশেতে ঊর্ধ্বে আছি ধ'রে চরম আত্মদান। তোমার অভিমান আঁধার ক'রে আছে আমার সমস্ত জগৎ, পাই নে খুঁজে সার্থকতার পথ।
সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না লেখা সহজে। লেখার কথা মাথায় যদি জোটে তখন আমি লিখতে পারি হয়তো। কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে, যা-তা লেখা তেমন সহজ নয় তো। যদি দেখ খোলসটা খসিয়াছে বৃদ্ধের, যদি দেখ চপলতা প্রলাপেতে সফলতা ফলেছে জীবনে সেই ছেলেমিতে-সিদ্ধের, যদি ধরা পড়ে সে যে নয় ঐকান্তিক ঘোর বৈদান্তিক, দেখ গম্ভীরতায় নয় অতলান্তিক, যদি দেখ কথা তার কোনো মানে-মোদ্দার হয়তো ধারে না ধার, মাথা উদ্ভ্রান্তিক, মনখানা পৌঁছয় খ্যাপামির প্রান্তিক, তবে তার শিক্ষার দাও যদি ধিক্কার-- সুধাব, বিধির মুখ চারিটা কী কারণে। একটাতে দর্শন করে বাণী বর্ষণ, একটা ধ্বনিত হয় বেদ-উচ্চারণে। একটাতে কবিতা রসে হয় দ্রবিতা, কাজে লাগে মনটারে উচাটনে মারণে। নিশ্চিত জেনো তবে, একটাতে হো হো রবে পাগলামি বেড়া ভেঙে উঠে উচ্ছ্বাসিয়া। তাই তারি ধাক্কায় বাজে কথা পাক খায়, আওড় পাকাতে থাকে মগজেতে আসিয়া। চতুর্মুখের চেলা কবিটিরে বলিলে তোমরা যতই হাস, রবে সেটা দলিলে। দেখাবে সৃষ্টি নিয়ে খেলে বটে কল্পনা, অনাসৃষ্টিতে তবু ঝোঁকটাও অল্প না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর