মাঝে মাঝে আসি যে তোমারে গান শিখাবারে-- মনে তব কৌতুক লাগে, অধরের আগে দেখা দেয় একটুকু হাসির কাঁপন। যে-কথাটি আমার আপন এই ছলে হয় সে তোমারি। তারে তারে সুর বাঁধা হয়ে যায় তারি অন্তরে অন্তরে কখন তোমার অগোচরে। চাবি করা চুরি, প্রাণের গোপন দ্বারে প্রবেশের সহজ চাতুরী, সুর দিয়ে পথ বাঁধা যে-দুর্গমে কথা পেত পদে পদে পাষাণের বাধা-- গানের মন্ত্রেতে দীক্ষা যার এই তো তাহার অধিকার। সেই জানে দেবতার অলক্ষিত পথ শূন্যে শূন্যে যেথা চলে মহেন্দ্রের শব্দভেদী রথ। ঘনবর্ষণের পিছে যেমন সে বিদ্যুতের খেলা বিমুখ নিশীথবেলা, অমোঘ বিজয়মন্ত্র হানে দূর দিগন্তের পানে, আঁধারের সংকোচ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মেঘমল্লারের ঝড়ে।
যে কাল হরিয়া লয় ধন সেই কাল করিছে হরণ সে ধনের ক্ষতি। তাই বসুমতী নিত্য আছে বসুন্ধরা। একে একে পাখি যায়, গানের পসরা। কোথাও না হয় শূন্য, আঘাতের অন্ত নেই, তবুও অক্ষুণ্ন বিপুল সংসার। দুঃখ শুধু তোমার আমার নিমেষের বেড়া-ঘেরা এখানে ওখানে। সে বেড়া পারায়ে তাহা পৌঁছায় না নিখিলের পানে। ওরে তুমি, ওরে আমি, যেখানে তোদের যাত্রা একদিন যাবে থামি সেখানে দেখিতে পাবি ধন আর ক্ষতি তরঙ্গের ওঠা নামা,একই খেলা, একই তার গতি। কান্না আর হাসি এক বীণাতন্ত্রীতারে একই গান উঠিছে উচ্ছ্বাসি, একই শমে এসে মহামৌনে মিলে যায় শেষে। তোমার হৃদয়তাপ তোমার বিলাপ চাপা থাক্ আপনার ক্ষুদ্রতার তলে। যেইখানে লোকযাত্রা চলে সেখানে সবার সাথে নির্বিকার চলো একসারে, দেখা দাও শান্তিসৌম্য আপনারে -- যে-শান্তি মৃত্যুর প্রান্তে বৈরাগ্যে নিভৃত, আত্মসমাহিত; দিবসের যত ধূলিচিহ্ন, যত কিছু ক্ষত লুপ্ত হল যে শান্তির অন্তিম তিমিরে; সংসারের শেষ তীরে সপ্তর্ষির ধ্যানপুণ্য রাতে হারায় যে শান্তিসিন্ধু আপনারি অন্ত আপনাতে; যে শান্তি নিবিড় প্রেমে স্তব্ধ আছে থেমে, যে-প্রেম শরীরমন অতিক্রম করিয়া সুদূরে একান্ত মধুরে লভিয়াছে আপনার চরম বিস্মৃতি। সে পরম শান্তি-মাঝে হোক তব অচঞ্চল স্থিতি।